রহমত, মাগফিরাত ও ক্ষমা লাভের মহিমান্বিত মাস পবিত্র রমজানুল মোবারক বিদায় নিয়েছে। বিদায় নিয়েছে ইফতার, সাহরি ও রোজা পালনের আনন্দ। এ মাস ছিল সিয়ামসাধনার। ছিল আল্লাহর নৈকট্য লাভের সুবর্ণ সুযোগ। এ মাসে আল্লাহর বান্দারা অনেকেই ধন্য হয়েছে। নেক কাজের প্রশংসনীয় অনুশীলন করেছে। বাড়িয়ে দিয়েছে সব ধরনের পুণ্য আমল। বর্জন করেছে গর্হিত কাজকর্ম। তবে পরিপূর্ণ সফলতা লাভের জন্য ভালো আমলের ধারাবাহিকতা বজায় রাখা জরুরি। নিয়মিতভাবে আমলও চালিয়ে যেতে হবে। আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত, ‘আল্লাহতায়ালার কাছে সর্বাপেক্ষা পছন্দনীয় আমল যা নিয়মিত হয়। যদিও তা পরিমাণে অল্প হয় (বুখারি, মুসলিম)।’
পবিত্র রমজান মাস বিদায় নিলেও রমজানের ইতিবাচক দিকগুলো ত্যাগ করা কোনো মুসলমানের জন্য উচিত হবে না। অতএব আমাদের জন্য মৌলিকভাবে করণীয় কাজ হলো- নফল রোজা, নফল নামাজ, কোরআন তেলাওয়াত ও সততায় অভ্যস্ত হওয়া। মিথ্যা, প্রতারণা, অশ্লীলতা ও ঝগড়াবিবাদ চিরতরে পরিহার করা। ভালো কাজ কবুল হওয়ার নিদর্শন হলো পরবর্তী সময়ে ভালো কাজের প্রতি আগ্রহ সৃষ্টি হওয়া। রমজানের পরেও যদি ভালো আমলের ধারা অব্যাহত থাকে তাহলে তা রমজানের আমলগুলো কবুল হওয়ার একটি নিদর্শন বহন করে। আল্লাহতায়ালা ইরশাদ করেন, ‘যখন তুমি (ফরজ দায়িত্ব থেকে) অবসর হবে, (নফল ইবাদতের মাধ্যমে) তোমার প্রতিপালকের প্রতি মনোনিবেশ কর (সুরা ইনশিরাহ-৭, ৮)।’ রমজান-পরবর্তী একটি কাজ শাওয়ালের ছয়টি নফল রোজা পালন করা। মহানবী (সা.) ইরশাদ করেন, ‘যে ব্যক্তি রমজানের রোজা পালন করবে, অতঃপর শাওয়াল মাসে ছয়টি রোজা আদায় করবে, সে যেন পূর্ণ বছর রোজা পালন করেছে।’ (মুসলিম)। বস্তুত এ হাদিসে কোরআনের মর্ম- প্রতিটি আমলে দশ গুণ সওয়াব তা-ই বিবৃত হয়েছে। অতএব রমজানের এক মাসের দশ গুণ হলো দশ মাস, আর শাওয়ালের ছয় দিনের দশ গুণ হলো ৬০ দিন বা দুই মাস। এভাবে পূর্ণ হলো এক বছর রোজার বিনিময়।
পবিত্র রমজান মাসে প্রায় সব মুসলমান আপন আপন অবস্থান থেকে ইবাদত-বন্দেগিতে অগ্রগতি লাভ করে। রমজান পরবর্তী সময়ে সেই অগ্রগতিতে অবহেলা কোনোভাবেই কাম্য নয়। মুমিন ব্যক্তি সব কাজে প্রতিনিয়ত অগ্রসর হবে। ভালো কাজে পেছনে যাওয়া মুমিনের জন্য মোটেও শুভলক্ষণ নয়। মহান প্রভু ঘোষণা করেন, ‘তোমরা সে নারীর মতো হইও না, যে তার সুতা মজবুত করে পাকানোর পর ওর পাক খুলে নষ্ট করে দেয় (সুরা আন নাহল-৯২)।’
প্রকৃত মুমিনের ইবাদতে বিরতি নেই, ইতি নেই, আল্লাহর নৈকট্য অর্জনের সাধনা চলবে তার আমৃত্যু। আল্লাহতায়ালা ইরশাদ করেন, ‘তুমি তোমার প্রতিপালকের ইবাদত কর মৃত্যু আসার আগপর্যন্ত (সুরা আল হাজর-৯৯)।’
রমজান-পরবর্তী একটি জরুরি কাজ হলো নিয়মিত নামাজ আদায় করা। রোজা আল্লাহতায়ালার একটি ফরজ বিধান। নামাজ আরও গুরুত্বপূর্ণ ফরজ বিধান। শেষ বিচারের দিন সর্বপ্রথম নামাজের বিষয়ে জিজ্ঞাসা করা হবে। নামাজের মাধ্যমে মুসলিম ও অমুসলিমের মধ্যে পার্থক্য বোঝা যায়। অতএব প্রতিটি মুমিন মুসলমানের নামাজ আদায়ের প্রতি যত্নশীল হওয়া খুবই গুরুত্বপূর্ণ। নামাজ যথাযথ ও সঠিকভাবে কায়েম হওয়ার অন্যতম সহায়ক হলো, মসজিদে গিয়ে জামাতের সঙ্গে নামাজ আদায় করা। রমজানে আমরা অনেকেই জামাতে নামাজ আদায় করি। এশার নামাজ ও তারাবিহর নামাজ জামাতবদ্ধভাবে আদায় করি। রমজানের পর এ ভালো কাজটি বর্জন করা নিন্দনীয়। এভাবে রমজানে যেভাবে কোরআন খতম ও কোরআন তেলাওয়াত করা হয়ে থাকে, গোটা বছর কোরআন তেলাওয়াত চালু রাখা মুমিন জীবনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ আমল। আল্লাহর স্মরণে একাগ্রতা, তাসবিহ ও ইস্তিগফার চালু রাখা শেষ পরিণাম ভালো হওয়ার নিদর্শন। আল্লাহতায়ালা সহায় হোন।
রমজান মাসে আমরা সংযমী হওয়ার প্রশিক্ষণ নিয়েছি। আমরা বর্জন করেছি রমজানে দিনের বেলায় পানাহার ও স্ত্রী সহবাস। এ কাজগুলো মূলত হালাল ও বৈধ। হালাল কাজ বর্জন করার অনুশীলনে লক্ষ্য ছিল যাবতীয় হারাম, নিষিদ্ধ কাজ এবং পাপাচার বর্জনে অভ্যস্ত হওয়া। যারা গোটা এক মাস হালাল কাজগুলো বর্জন করেছি, কিন্তু এখনো হারাম ও নিষিদ্ধ কাজ, যেমন মিথ্যা বলা, মিথ্যার আশ্রয় নেওয়া, দুর্নীতি করা, প্রতারণা, হিংসা, নিন্দা, অহংকার, অপরের দোষ চর্চা, কারও অধিকার হরণ করা ইত্যাদি অপকর্ম বর্জন করিনি- তাহলে রোজার আসল উদ্দেশ্য সফল হয়নি। হয়নি সিয়ামসাধনার বাস্তব অনুশীলন। এ রোজা আল্লাহর কাছে কবুল হওয়ার আশা করা যায় না। রসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন, ‘যে ব্যক্তি মিথ্যা বলা ও তার ওপর আমল করা পরিহার করল না, তার পানাহার বর্জন আল্লাহর কোনো প্রয়োজন নেই (বুখারি)।’ অতএব পাপাচারমুক্ত জীবন গড়াই প্রকৃত সিয়ামসাধনা। রমজান-পরবর্তী জীবনটাও আমাদের এভাবেই গড়তে হবে।
লেখক : গবেষক, ইসলামিক রিসার্চ সেন্টার বসুন্ধরা, ঢাকা