এবার পবিত্র ঈদুল ফিতরের ছুটি দীর্ঘদিন হওয়ায় ঈদযাত্রায় সড়কে তেমন ভোগান্তি ছিল না। আবার ছুটি শেষে দুর্ভোগ ছাড়াই রাজধানী ঢাকায় ফিরছেন লোকজন। তবে ঈদ-পূর্ববর্তী ও পরবর্তী সময়ে দেশের বিভিন্ন সড়কে অর্ধশত মানুষের প্রাণহানির খবর পাওয়া গেছে। আহতের সংখ্যা শতাধিক বলে খবরে প্রকাশ। ৩ এপ্রিল বাংলাদেশ প্রতিদিনে এসব দুর্ঘটনার খবর বিস্তারিত ছাপা হয়েছে। ঈদের আনন্দের পরিবর্তে বিষাদ নেমে এসেছে নিহত ও আহতদের পরিবারে। শোকে হতবিহ্বল স্বজনরা।
সংবাদমাধ্যমের খবর অনুযায়ী, ঈদের তৃতীয় দিন (২ এপ্রিল) সকালে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কের লোহাগাড়ায় এক ভয়াবহ সড়ক দুর্ঘটনায় ১১ জন প্রাণ হারান। এর মধ্যে পাঁচজন একই পরিবারের বলে জানা গেছে। তাদের বাড়ি পিরোজপুরে। ঈদের ছুটিতে মাইক্রোবাসযোগে ঢাকা থেকে কক্সবাজারে বেড়াতে যাচ্ছিলেন তারা। ঘটনার বিবরণে প্রকাশ, চট্টগ্রামমুখী বাসের সঙ্গে কক্সবাজারগামী ওই মাইক্রোবাসের সংঘর্ষে এই মর্মান্তিক দুর্ঘটনা ঘটে। দুর্ভাগ্যক্রমে যে স্থানে দুর্ঘটনাটি ঘটে, সেখান থেকে মাত্র ৩০-৩৫ গজ দূরে ঈদের দিন (৩১ মার্চ) সকালে বাস ও মিনিবাসের সংঘর্ষে পাঁচজনের মৃত্যু হয়েছিল। তা ছাড়া ঈদের পরদিন (১ এপ্রিল) একই স্থানে দুটি মাইক্রোবাস নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে খাদে পড়ে যায়। এতে আটজন আহত হন। পরপর তিন দিন একই স্থানে তিনটি পৃথক দুর্ঘটনায় ১৫ জনের মৃত্যু ও বেশ কয়েকজন আহত হওয়ার ঘটনায় দেশজুড়ে চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়েছে। এদিকে ঈদের আগের দিন ময়মনসিংহের গৌরীপুরে বাসচাপায় একই পরিবারের চারজনের মৃত্যু হয়। ঈদ করার জন্য অটোরিকশাযোগে ময়মনসিংহ শহর থেকে বাড়িতে ফিরছিলেন তারা। অন্যদিকে ঈদের পরদিন কুমিল্লার চান্দিনায় বাস দুর্ঘটনায় তিনজন নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন বেশ কয়েকজন। বাসটি ঢাকা থেকে যাত্রী নিয়ে কুমিল্লায় যাচ্ছিল। ঈদের দুই দিন আগে (২৯ মার্চ) বরগুনার পাথরঘাটা উপজেলায় বাস-মোটরসাইকেল মুখোমুখি সংঘর্ষে মোটরসাইকেল আরোহী তিন সহোদর নিহত হয়েছেন। এই মর্মান্তিক ঘটনা চোখে জল এনেছে বহু মানুষের। দুই চাকার মোটরসাইকেল যেন মৃত্যুদূত! ঈদের আগে ও পরে দেশের বিভিন্ন স্থানে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় অকালে ঝরে পড়েছে সম্ভাবনাময় অনেক প্রাণ। মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় প্রাণহানি এখন নিত্যদিনের ঘটনা। প্রায় প্রতিদিনই দেশের কোথাও না কোথাও ঝরছে প্রাণ। গতির নেশায় মেতে ওঠে জীবনের নিরাপত্তার কথা ভুলে যান অনেকে। ঝুঁকি নিয়ে অতিরিক্ত গতিতে বাইক চালিয়ে বেঘোরে প্রাণ হারাচ্ছেন সড়কে। আশ্চর্যের বিষয়, মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় এত মৃত্যুর পরও আমাদের সচেতনতা প্রায় শূন্যের কোঠায়! মহাসড়কের দুর্ঘটনাপ্রবণ এলাকাগুলো চিহ্নিত করে ব্যবস্থা গ্রহণ জরুরি হয়ে পড়েছে। প্রশ্ন উঠেছে, চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কের লোহাগাড়ায় একই সড়কে বারবার কেন দুর্ঘটনা ঘটছে? বাংলাদেশ প্রতিদিনের খবর, এক বছরে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার সড়কের ঝুঁকিপূর্ণ অংশে প্রাণ হারিয়েছেন ১৩০ জন। ঢালু পাহাড়ি রাস্তা, অপ্রশস্ত সড়ক আর ঘন ঘন বিপজ্জনক বাঁকের কারণে এই সড়কে অহরহ দুর্ঘটনা ঘটছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। লবণ ও মাছ বহনকারী গাড়ি থেকে পানি পড়ে সড়ক পিচ্ছিল হওয়া দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ। সারা দেশ থেকে বাস, মাইক্রোবাস ও প্রাইভেট কার নিয়ে অনেক পর্যটক যান কক্সবাজারে। অচেনা নির্জন সড়কে আঁকাবাঁকা পথে অতিরিক্ত গতিতে গাড়ি চালানোর কারণে দুর্ঘটনা ঘটছে। তা ছাড়া, একটানা গাড়ি চালানোর ফলে ট্রাকচালকরা যথেষ্ট বিশ্রাম পান না। পর্যাপ্ত বিশ্রাম এবং ঘুমের অভাবে ক্লান্ত ও তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে গাড়ি চালানোর ফলে অনেক সময় ঘটে ভয়াবহ দুর্ঘটনা। উৎসবের দিনগুলোতে একটা ট্রিপ শেষ করে বাস ড্রাইভারদের ছুটতে হয় ফিরতি ট্রিপ নিয়ে। বিশ্রাম নেই। আবার নেশাগ্রস্ত অবস্থায় দিগি¦দিক জ্ঞানশূন্য হয়ে বেপরোয়া গতিতে গাড়ি চালানোর ফলে দুর্ঘটনা ঘটছে। পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, শেষ রাতে অনেক নৈশকোচ ও ট্রাক দুর্ঘটনায় পতিত হয়েছে। সড়ক-মহাসড়কে এখন গলার কাঁটা তিন চাকার যান। ধীরগতির ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা ও ইজিবাইকের যন্ত্রণায় চার চাকার দ্রুতগতির ভারী যানবাহনগুলো স্বাচ্ছন্দ্যে চালানো দায় হয়ে পড়েছে। যানবাহন চালকদের বেপরোয়া মনোভাব, অতিরিক্ত গতিতে গাড়ি চালানো ও ওভারটেকিংয়ের কারণে সড়ক দুর্ঘটনা অহরহ ঘটছে।
সড়ক দুর্ঘটনার কারণগুলো চিহ্নিত। কিন্তু সমাধানের ব্যাপারে আমাদের আন্তরিক প্রয়াসে যে ঘাটতি আছে, তা অস্বীকার করা যাবে না। নইলে বছরের পর বছর কেন একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হচ্ছে? পদ্মা সেতু পার হয়ে ফরিদপুরের ভাঙ্গা ক্রসিং থেকে ভাটিয়াপাড়া হয়ে গোপালগঞ্জ পর্যন্ত সড়কের কথাই ধরা যাক। ব্যস্ত এই মহাসড়কে কোনো রোড ডিভাইডার না থাকায় ঝুঁকিপূর্ণ এই সড়কটি এখন দুর্ঘটনার ‘হটস্পট’।
সড়ক দুর্ঘটনার আধিক্যের ব্যাপারে এককভাবে কাউকে দায়ী করা যায় না। যানবাহনের মালিক, চালক, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, পথচারী সবার গাফিলতি আছে। একের পর এক সড়ক দুর্ঘটনায় মর্মান্তিক মৃত্যু এক কঠিন প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেয় আমাদের- নিরাপদ সড়কের স্বপ্ন কী অধরাই থেকে যাবে? আমরা কবে আর সচেতন হব? এখন হাত গুটিয়ে বসে থাকার সময় নেই। আমাদের সবাইকে যার যার অবস্থান থেকে দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করে যেতে হবে। নিরাপদ সড়কের সঙ্গে আমাদের জীবন-মৃত্যুর প্রশ্ন জড়িত। এ নিয়ে হেলাফেলা করা সাজে না!
লেখক : সাবেক উপব্যবস্থাপনা পরিচালক, জনতা ব্যাংক পিএলসি