আরবের সবচেয়ে বিস্তৃত ধর্ম ছিল শিরক। শিরকের অর্থ এই যে ইলাহ হিসেবে এক সত্তার প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করে তাঁর সাহায্য-সহযোগিতার জন্য তাঁর সাহায্যকারী ও সহযোগী স্থির করা। অর্থাৎ আল্লাহর সঙ্গে অন্যদের শরিক করা। এমন আকিদা-বিশ্বাস ছিল সংখ্যাগরিষ্ঠ আরবের।
তারা সব ধরনের দেবতায় ও দেবীতে বিশ্বাসী ছিল। মূর্তির সামনে সিজদাবনত হতো। জিন ও ফেরেশতাদের উদ্দেশ্যে পশু কোরবানি দিত। তবে এক মহান শক্তির প্রতিও তারা বিশ্বাসী ছিল।
এই শত শত উপাস্যের ভিড়ে সেই পবিত্র অস্তিত্ব ছিল সমুজ্জ্বল, যার নাম দিয়েছিল তারা ‘আল্লাহ’। তারা বিশ্বাস করত যে আল্লাহই আকাশসমূহ ও পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন এবং জগতের অন্য যত বড় বড় সৃষ্টবস্তু আছে সব কিছু তিনিই সৃষ্টি করেছেন।
এ কারণেই জাহেলি যুগের কবিদের কবিতায় আল্লাহ নামটি বারবার এসেছে। তবে এসব মূর্তি, দেবদেবী ও ফেরেশতাদের চিত্রিত করা হয়েছে আল্লাহর নৈকট্য লাভের উপায় হিসেবে। এটাই ছিল তাদের বিশ্বাস।
তারা এসব দেবদেবীর পূজা করত এ কারণে যে এগুলো খুশি হয়ে তাদের প্রতি আল্লাহকে সন্তুষ্ট রাখবে। পবিত্র কোরআন কয়েক স্থানে আরবের কাফিরদের এই দোষের কথা উল্লেখ করেছে যে তারা যদি আল্লাহকে আকাশ, পৃথিবী ও নক্ষত্ররাজির স্রষ্টা হিসেবে বিশ্বাসই করে থাকে এবং বিশ্বাস করে থাকে যেসব শক্তি ও কর্তৃত্ব তাঁরই হাতে আছে তাহলে কেন তারা অন্যদের উপাসনা করে?
পবিত্র কোরআনে মহান আল্লাহ বলেন, ‘জিজ্ঞেস করো, এই পৃথিবী এবং তাতে যারা আছে তারা কার, যদি তোমরা জান? তারা বলবে, আল্লাহর।
বলো, তবু কি তোমরা শিক্ষা গ্রহণ করবে না?
জিজ্ঞেস করো, কে সপ্ত আকাশ এবং মহা আরশের অধিপতি? তারা বলবে, আল্লাহ।
বলো, তবু কি তোমরা সাবধান হবে না?
জিজ্ঞেস করো, সব কিছুর কর্তৃত্ব কার হাতে, যিনি আশ্রয় দান করেন এবং যার ওপর আশ্রয়দাতা নেই, যদি তোমরা জানো?
তারা বলবে, আল্লাহর।
বলো, তবু তোমরা কেমন করে মোহগ্রস্ত হচ্ছ?
বরং আমি তো তাদের কাছে সত্য পৌঁছিয়েছি; কিন্তু তারা তো নিশ্চিত মিথ্যাবাদী। আল্লাহ কোনো সন্তান গ্রহণ করেননি এবং তাঁর সঙ্গে কোনো ইলাহ নেই; যদি থাকত তবে প্রত্যেক ইলাহ নিজ নিজ সৃষ্টি নিয়ে পৃথক হয়ে যেত এবং একে অপরের ওপর প্রাধান্য বিস্তার করত। তারা যা বলে তা থেকে আল্লাহ কত পবিত্র!’ (সুরা : মুমিনুন : আয়াত : ৮৪-৯১)
উপযুক্ত আয়াতগুলোতে মুশরিকদের আকিদা-বিশ্বাসের বিস্তারিত বর্ণনা রয়েছে। আল্লাহর সন্তান গ্রহণসংক্রান্ত যে বিশ্বাসকে প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে তা খ্রিস্টানদের সঙ্গে সম্পৃক্ত নয়, বরং মুশরিকদের সঙ্গে সম্পৃক্ত। তারা ফেরেশতাদের আল্লাহর সন্তান মনে করত। অন্যান্য আয়াতেও এ বিষয়ের বর্ণনা রয়েছে। আল্লাহ বলেন,
‘বলো, কে তোমাদেরকে আকাশ ও পৃথিবী থেকে জীবনোপকরণ সরবরাহ করে অথবা শ্রবণ ও দৃষ্টিশক্তি কার কর্তৃত্বাধীন, জীবিতকে মৃত থেকে কে বের করে এবং সব কিছুকে কে নিয়ন্ত্রণ করে?
তারা তখন বলবে, আল্লাহ।
বলো, তবু কি তোমরা সাবধান হবে না।’
(সুরা : ইউনুস, আয়াত : ৩১)
এসব আয়াত থেকে বোঝা যায় যে তারা আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস রাখত। অন্য দেবদেবীকে তারা কী চোখে দেখত এবং কেন সেগুলোর উপাসনা করত তা নিম্নরূপ আয়াতগুলো থেকে প্রতীয়মান হয়।
পবিত্র কোরআনে এসেছে, ‘তারা আল্লাহ ব্যতীত যার ইবাদত করে তা তাদের ক্ষতিও করতে পারে না, উপকারও করতে পারে না। তারা বলে, এগুলো আল্লাহর নিকট আমাদের সুপারিশকারী।’
(সুরা : ইউনুস, আয়াত : ১৮)
সুরা জুমারে বর্ণিত হয়েছে, ‘যারা আল্লাহর পরিবর্তে অন্যদের অভিভাবকরূপে গ্রহণ করে তারা বলে, আমরা তো এদের পূজা এজন্যই করি যে এরা আমাদের আল্লাহর সান্নিধ্যে এনে দেবে।’ (সুরা : জুমার, আয়াত : ৩)
ফেরেশতাদের ব্যাপারে বিশ্বাস
ফেরেশতাদের সম্পর্কে তাদের এই বিশ্বাস ছিল যে ফেরেশতারা আল্লাহর কন্যা। এ কারণে তারা ফেরেশতাদের নারী গণ্য করত। পবিত্র কোরআন বলছে, ‘তবে কি তোমাদের জন্য পুত্রসন্তান এবং আল্লাহর জন্য কন্যাসন্তান? এই প্রকার বণ্টন তো অসংগত। এগুলো কতক নামমাত্র, যা তোমাদের পূর্বপুরুষরা ও তোমরা রেখেছ, যার সমর্থনে আল্লাহ কোনো দলিল প্রেরণ করেননি।’
(সুরা : নাজম, আয়াত : ২১-২৩)
তারপর মহান আল্লাহ বলছেন, ‘যারা আখিরাতে বিশ্বাস করে না তারাই ফেরেশতাদের নারীবাচক নাম দিয়ে থাকে।’
(সুরা : নাজম, আয়াত : ২৭)
সুরা তুরে বর্ণিত হয়েছে, ‘তবে কি কন্যাসন্তান তাঁর (আল্লাহর) এবং পুত্রসন্তান তোমাদের জন্য?’ (সুরা : তুর, আয়াত : ৩৯)
জিনদের ব্যাপারে বিশ্বাস
মুশরিকরা ভূতপ্রেত ও জিনে বিশ্বাস রাখত। তারা এগুলোকে দেবতা বা আল্লাহর সমকক্ষ বিশ্বাস করত। এগুলোর কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করত এবং এগুলোর ক্রোধ ও অসন্তুষ্টির ভয় করত। কোরআনে এসেছে,
‘তারা জিনকে আল্লাহর সঙ্গে শরিক করে, অথচ তিনিই তাদের সৃষ্টি করেছেন এবং তারা আল্লাহর প্রতি অজ্ঞতাবশত পুত্র-কন্যা আরোপ করে।’ (সুরা : আনআম, আয়াত : ১০০)
সুরা জিনে মহান আল্লাহ জিনদের বক্তব্য উল্লেখ করেছেন—‘আরো এই যে কিছু মানুষ কিছু জিনের শরণাপন্ন হতো, ফলে তারা জিনদের আত্মম্ভরিতা বাড়িয়ে দিত।’
(সুরা : জিন, আয়াত : ৬)
মুশরিকরা মহান আল্লাহ ও জিনদের মধ্যে আত্মীয়তার সম্পর্কও স্থাপন করত। বর্ণিত হয়েছে, ‘তারা আল্লাহ ও জিন জাতির মধ্যে আত্মীয়তার সম্পর্ক (জিন ও আল্লাহর মধ্যে বৈবাহিক সম্পর্ক ) স্থির করেছিল।’ (সুরা : সাফফাত, আয়াত : ১৫৮)
বিডি-প্রতিদিন/সালাহ উদ্দীন