ঈসা খাঁর রাজধানী ছিল সোনারগাঁ। মোগল আমলের বারো ভুঁইয়াদের মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী ছিলেন ঈসা খাঁ। এখানে বারো ভূইঁয়া প্রধান ঈসা খাঁ ও মুসা খাঁ এবং পূর্ববর্তী স্বাধীন সুলতানরা রাজত্ব করতেন। তাদের রাজত্বকালে তারা রাজধানীর বিভিন্ন জায়গায় মনোরম ইমারত, মসজিদ, খানকা ও সমাধি নির্মাণ করেন। প্রত্যেক মসজিদ, খানকা ও সমাধিতে মুসলিম ঐতিহ্যগত আরবীয় অলঙ্করণ পরিলক্ষিত হয়। প্রাচীন কীর্তির প্রত্যেকটি মসজিদ, খানকা ও সমাধি ছোট বড় প্রস্তর খণ্ড দিয়ে সুসজ্জিত।
সোনারগাঁ বর্তমানে ইতঃস্তত বিক্ষিপ্ত কতগুলো গ্রামের সমষ্টি মাত্র। পানাম, আমিনপুর, গোয়ালদী, মোগরাপাড়া, দমদমা, ভাগলপুর, শাহচিল্লাহপুর, মহজমপুর এসব গ্রামে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা পুরাকীর্তি সমূহের ধ্বংসাবশেষ। এসব গ্রামের অন্যতম হলো গোয়ালদী। এ গ্রামে সে সময়কার গৌরবময় দিনের যে সকল নিদর্শন বর্তমানে বিদ্যমান রয়েছে তার মধ্যে অন্যতম হোসেন শাহী মসজিদ। সোনারগাঁয়ের দ্বিতীয় উল্লেখ্যযোগ্য প্রাচীন কীর্তি এই মসজিদ মুসলিম স্থাপত্য শিল্পের এক অনুপম নিদর্শন। ইতিহাস ও উপাখ্যানে সোনারগাঁকে দেখা হয়েছে পরীর রানী হিসেবে। ইতিহাসে পূর্ব বাংলার রাজধানী সোনারগাঁকে হোসেন শাহী আমলে পরিচয় করে দেয়া হয়েছে স্বর্ণযুগ হিসেবে। কারণ, এ সময়কার আলাউদ্দিন হোসেন শাহ ছিলেন এক অনন্য সাধারণ প্রতিভা সম্পন্ন সুলতান। স্থাপত্যের প্রতি ছিল তার প্রগাঢ় অনুরাগ। তিনি নিমার্ণ করে গেছেন অসংখ্য মনোমুগ্ধকর মসজিদ ও মাদ্রাসা। তার বিস্তৃত রাজ্যের বিভিন্ন স্থানে যেসব মসজিদ নির্মিত হয়, তার মধ্যে এই ঐতিহাসিক গোয়ালদী মসজিদটি অন্যতম। বর্তমানে মসজিদটি দেখার জন্য প্রতিদিন দেশ বিদেশের দর্শনার্থী ও পর্যটক আসেন সোনারগাঁয়ে। সোনারগাঁয়ের বিভিন্ন পর্যটন স্পটগুলোর পাশাপাশি দর্শনার্থীদের হৃদয় জুড়াতে সক্ষম এমন অসংখ্য পুরাকীর্তির নিদর্শনের মাঝে হোসেন শাহী মসজিদ অন্যতম। এ মসজিদটির মনোরম নির্মাণশৈলী অনায়াসে দর্শনার্থীদের হৃদয় আকৃষ্ট করে।
জানা গেছে, আলাউদ্দিন হোসেন শাহের রাজত্বকালে মোল্লা হিজবার আকবর ৯২৫ হিজরী ১৫ শাবান মোতাবেক ১৫১৯ খ্রিস্টাব্দে ১২ আগস্ট এ মসজিদ নির্মাণ করেন। হোসেন শাহ ৯০৫ হিজরী থেকে ৯২৭ হিজরী পর্যন্ত রাজত্ব করেন এবং তিনি বাংলার সুলতানদের মধ্যে প্রসিদ্ধ ছিলেন। কারুকার্যময় মসজিদটি নিমার্ণের পর দীর্ঘদিন দর্শনীয় ইবাদতের স্থান হিসেবে ব্যবহৃত হওয়ার এক পর্যায়ে সংস্কারের অভাব ভগ্নস্তুপে পরিণত হয়। পরে তা আবার নির্মাণ করা হয়। পুনঃনির্মানের আগে মেহবার ও দেয়ালের কিছু অংশের অস্তিত্ব ছিল। সোনারগাঁয়ে গোয়ালদী গ্রামে মসজিদটি নির্মিত হয় বলে এটির নাম দেওয়া হয় গোয়ালদী হোসেন শাহী মসজিদ।
মসজিদ সম্পর্কে জেমস ওয়াইজ এশিয়াটিক সোসাইটি জার্নালে এবং স্যার কালিংহাম ১৮৭৯ সালে সার্ভে অফ ইন্ডিয়া রিপোর্টে বর্ণনা করেছেন। এ বর্ণনার ওপর ভিত্তি করে সরকারের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ আগের মত করে মসজিদটিকে নতুনভাবে নির্মাণ করেছে। গৌঢ়, পান্ডুয়া বাংলার অন্যান্য ইমারতাদির ন্যায় এই মসজিদের ভেতর ও বাহিরের দেয়ালের পাথর ও ইটে আরবীয় অলংকরণ পরিলক্ষিত হয়। ইট ও পাথরের মূল অলঙ্করণের কিছু নিদর্শন মসজিদের পশ্চিম দেয়ালের, বিশেষত মিহরাবে লক্ষ্য করা যায়। মসজিদের মেহরাবের গায়ে ফুল, লতাপাতা আঁকা বিভিন্ন নকশা এবং আরবি লিপির অলঙ্করণ। কেন্দ্রীয় মেহরাবটি চমৎকার। এটি কালো প্রস্তরে নির্মিত ও কারুকার্য খচিত। মসজিদের আয়তন বাইরের দিকে দৈর্ঘ্য প্রস্থ ২৬ ফুট করে। পলেস্তরা ছাড়াই লাল চিকন ইটের তৈরি বর্গাকার এক গম্বুজ বিশিষ্ট মসজিদটির ভেতরের প্রতিবাহুর দৈর্ঘ্য সাড়ে ১৬ ফুট এবং দেয়ালগুলো ছিল প্রায় পাঁচফুট প্রশস্ত। দেয়ালের উভয় দিকে ছিল অতিসুন্দর পোড়ামাটির চিত্রফলক, মসজিদের চারকোণায় রয়েছে চারটি গোলাকার মিনার। মিনারগুলো মেঝের সমান্তরাল থেকে ভূমির দিকে কয়েকটি স্তরে ক্রমশ মোটা। দীর্ঘদিনের অযত্নে ও মেরামতের অভাবে মসজিদটি গম্বুজের বেশিরভাগ ও উত্তরপূর্ব দক্ষিণ দেয়ালের উপরাংশ বিলুপ্ত হয়ে যায়। সম্ভবত এই কারণে মসজিদটি পরিত্যক্ত হয়ে যায়।
আশির দশকে প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ এ শাহী মসজিদটিকে প্রত্নতত্ত্ব'র আওতাভুক্ত করে এটি সংরক্ষণের ব্যবস্থা করে। সে সময় প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ মসজিদটির ব্যাপক সংস্কার করে। এতে ফুল, লতা-পাতা নকশা সংবলিত পোড়ামাটির ফলক স্থাপন করা হয়। এখন মসজিদটির প্রকৃত রূপ অনেকটাই বদলে যায়। মসজিদের গায়ে যেসব মূল্যবান কারুকাজ খচিত পাথরের ফলক ছিল সেগুলো প্রত্নতত্ত্ব অধিদফতরের আওতাভুক্তির আগেই চুরি হয়ে গেছে। বর্তমানে মসজিদটি রক্ষণাবেক্ষণে রয়েছে।
এ মসজিদ সংলগ্ন উত্তর দিকে আরো একটি মসজিদ রয়েছে। এটিও এক গম্বুজ বিশিষ্ট। মসজিদটির বিদ্যমান শিলালিপি থেকে জানা যায় যে, ঐ মসজিদটি আব্দুল হামিদ হিজরী ১১১৬ এবং ১৭০৫ খ্রিষ্টাব্দে নির্মাণ করেন। তখন থেকেই পুনরায় ঐ মসজিদে স্থানীয় লোকেরা নামাজ আদায় করে আসছে। এ মসজিদটি দেখতে হোসেন শাহী মসজিদের মতোই।
গোয়ালদী গ্রামের হাদিস ভূইয়া, নাইম আহমেদসহ কয়েকজন স্থানীয় বাসিন্দা জানান, সুলতানী আমলের গৌরবোজ্জল মুসলিম ঐতিহ্যের অন্যতম সাক্ষী এ গোয়ালদী মসজিদ। এ মসজিদটির কারণে আমরা এলাকাবাসীরা নিজেদের সম্মানিত ভাবি। কারণ ঐতিহাসিক এ পুরাকীর্তি পরিদর্শন করতে প্রতিদিন দেশবিদেশের পর্যটকরা ভিড় জমায়।
প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের দায়িত্বপ্রাপ্ত সোনারগাঁয়ের পানাম নগরীর তত্ত্বাবধায়ক সিয়াম হোসেন জানান, গোয়ালদী শাহী মসজিদটি বাংলাদেশ প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের আওতায় রয়েছে। এ মসজিদটি বেশকিছু সংস্কার করা হয়েছে। ধারাবাহিকভাবে এ মসজিদটিও আরো সংস্কারের আওতায় নিয়ে আসা হবে।
বিডি প্রতিদিন/নাজমুল