আর এক দিন পরেই বৈশাখ। ধর্ম-বর্ণ-গোত্র নির্বিশেষে সর্বজনীন বাঙালির প্রাণের উৎসব। ‘মুছে যাক গ্লানি, ঘুচে যাক জরা, অগ্নিস্নানে সূচি হোক ধরা’ রবীন্দ্রনাথের অমর কবিতার পঙ্ক্তিতে উদ্বুুদ্ধ হয়ে পুরোনো বছরের জরাজীর্ণতা, গ্লানি ও বিষাদ ভুলে সফলতার স্বপ্নে বঙ্গাব্দ ১৪৩২ বরণ করবে গোটা জাতি। পুরোনো দিনের সব ব্যর্থতা, না পাওয়া ও গ্লানি মুছে ফেলে নতুন দিনে সমৃদ্ধি ও সফলতার দিকে এগিয়ে যাওয়ার প্রত্যয়ে হালখাতায় দেনা-পাওনার হিসাব চুকিয়ে পুরোনো বছর বঙ্গাব্দ ১৪৩১ বিদায় জানিয়ে বাংলা নববর্ষ ১৪৩২ বরণে প্রাণের বাংলাদেশ মেতে উঠবে বর্ণিল উৎসবে। ঋতুচক্রের পালাবদলে বসন্ত শেষে পুরোনো বছরের বিদায়ের সুর বেজে উঠেছে প্রকৃতিতে। পান্তা, ইলিশ, মুড়ি, মুড়কি দিয়ে আপ্যায়নের পাশাপাশি আবহমান বাংলা সংস্কৃতি জারি, সারি, ভাটিয়ালি, পুথি, পালাসহ নানা বর্ণাঢ্য আয়োজনে বৈশাখ উদ্যাপনে মেতে উঠবে রাজধানীসহ সারা দেশ। সাংস্কৃতিক অঙ্গনেই বৈশাখি উন্মাদনা বেশি লক্ষ করা যাবে। নববর্ষের সবচেয়ে বড় আয়োজন চারুকলা অনুষদের ‘বর্ষবরণ আনন্দ শোভাযাত্রা’। এ শোভাযাত্রার দিকেই দেশবাসীর চোখ আটকে আছে। বিশেষ করে রাজধানীর বাসিন্দারা এ শোভাযাত্রাটির প্রতিই তাকিয়ে থাকেন। যার কারণে চারুকলা অনুষদের শোভাযাত্রাটিই বৈশাখ উদ্যাপনের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে। চব্বিশের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে এবারের শোভাযাত্রার প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করা হয়েছেথ- ‘নববর্ষের ঐকতান, ফ্যাসিবাদের অবসান’। বিশেষ এ শোভাযাত্রা নিয়ে বরাবরের মতো এবারও ব্যস্ত সময় পার করছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের শিক্ষার্থীরা। ফ্যাসিবাদ-পরবর্তী নতুন বাংলাদেশের শোভাযাত্রাটির দিকে এবার চোখ রাখছেন সংস্কৃতি অনুরাগীরাও। বাঙালির সর্বজনীন এ উৎসব ঘিরে বর্ণিল হয়ে উঠেছে চারুকলা অনুষদ প্রাঙ্গণ। শেষ মুহূর্তের প্রস্তুতি লক্ষ করা গেছে চারুকলা অনুষদে। সেখানে চলছে শোভাযাত্রার বিভিন্ন শিল্প-কাঠামো নির্মাণের কাজ।
শোভাযাত্রা উদ্যাপন পরিষদের সদস্যসচিব ও চারুকলার অধ্যাপক এ এ এম কাওসার হোসেন টগর বলেন, ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ হিসেবে মাথায় খাড়া দুটি শিংওয়ালা দৈত্যাকৃতির একটি প্রতিকৃতিকেই ফ্যাসিবাদের প্রতীক হিসেবে বেছে নেওয়া হয়েছে। এটিই এবারের শোভাযাত্রার প্রধান মোটিফ বা অবকাঠামো। এর সঙ্গে আরও চারটি মোটিফ রয়েছে। যেমন- জাতীয় মাছ ‘ইলিশ’, সোনারগাঁয়ের ঐতিহ্যবাহী লোকশিল্পীদের কাঠের বাঘ, শান্তির পায়রা আর জুলাই গণ অভ্যুত্থানে শহীদ মীর মুগ্ধের স্মৃতি স্মরণ করে একটি পানির বোতল। সব কটি মোটিফের নির্মাণকাজ অনেক দূর এগিয়েছে। বলতে গেলে বাঁশ-কাঠের কাজ প্রায় শেষ। এখন কাগজ, চট বা কাপড় বসিয়ে তাতে রং লাগিয়ে চূড়ান্ত করা বাকি। গতকাল সরেজমিনে দেখা গেল শিক্ষার্থীদের কর্মব্যস্ততা।
শিল্পকর্ম নির্মাণে ব্যস্ত ঢাবি চারুকলার ভাস্কর্য বিভাগের সাবেক শিক্ষার্থী ও শান্ত-মারিয়াম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রভাষক মাহমুদুল হাসান জানান, ফ্যাসিস্টের দৈত্যাকৃতির প্রতিকৃতির উচ্চতা প্রায় ২০ ফুট। ইলিশ মাছ, বাংলার বাঘ ও পায়রার উচ্চতা হবে ১৬ ফুট।
শোভাযাত্রার সার্বিক তত্ত্বাবধানে থাকা ঢাবি চারুকলা অনুষদের ডিন আজহারুল ইসলাম চঞ্চল বলেন, চব্বিশের চেতনা ধারণ করে সমকাল, ইতিহাস, ঐতিহ্যকে মাথায় রেখে এবারের শোভাযাত্রার পরিকল্পনা সাজানো হয়েছে। যে জন্য এবার এ শোভাযাত্রার প্রতিপাদ্য- ‘নববর্ষের ঐকতান, ফ্যাসিবাদের অবসান’। পাঁচটি মোটিফ করা হচ্ছে জানিয়ে তিনি জানান, এবারের শোভাযাত্রায় পাঁচটি বড় মোটিফের পাশাপাশি সমকালীন বিভিন্ন বিষয়ের ছোট-বড় নানা মোটিফ যুক্ত হবে। থাকবে ঐতিহ্যবাহী পালকি, পাখা, সুলতানি আমলের মোগল মিনিয়েচারভিত্তিক মুখোশ।
এদিকে বৈশাখ উদ্যাপনের অন্যতম কার্যক্রম হিসেবে চারুকলার বকুলতলায় বাংলা বছরের শেষ দিন চৈত্রসংক্রান্তির ও নববর্ষবরণের সাংস্কৃতিক কর্মসূচিও হাতে নিয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদ। ১৩ এপ্রিল চৈত্রসংক্রান্তি উদ্যাপনের মধ্য দিয়ে শুরু হবে এ অনুষ্ঠান। বিকাল ৩টা থেকে নাচ-গানের এ আয়োজন চলবে রাত ৮টা পর্যন্ত। আর ১৪ এপ্রিল সকালে বের হবে শোভাযাত্রা। ১৫ এপ্রিল সন্ধ্যায় চারুকলার বকুলতলার মঞ্চে পরিবেশিত হবে বাংলার ঐতিহ্যবাহী ‘যাত্রাপালা’। প্রতি বছর চারুকলার শিক্ষার্থীদের অভিনয়ে এ যাত্রাপালা পরিবেশিত হলেও এবার একটা পেশাদার যাত্রাদল এই যাত্রাপালা পরিবেশন করবে।
এদিকে জানা গেছে, রাজশাহীর ঐতিহ্যবাহী শখের হাঁড়ির নকশা দিয়ে সাজিয়ে তোলা হবে চারুকলা অনুষদের সীমানাপ্রাচীর। লোকশিল্পের মোটিফ ফুল-পাখি-লতাপাতা দিয়ে নান্দনিক করে তোলা হবে দেয়াল।
‘আমার মুক্তি আলোয় আলোয়’ প্রতিপাদ্যে বর্ষবরণ করবে ছায়ানট : বরাবরের মতো এবারও রমনার বটমূলে প্রভাতী অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে বৈশাখ উদ্যাপন করবে সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান ছায়ানট। প্রতিষ্ঠানটির এবারের প্রতিপাদ্য- ‘আমার মুক্তি আলোয় আলোয়’। পয়লা বৈশাখের ভোরের আলো ফুটতে ফুটতে ভৈরবীতে রাগালাপ দিয়ে শুরু হবে তাদের বাংলা নববর্ষ বরণের সূচনা। এতে আরও থাকবে নতুন আলো, প্রকৃতি এবং মানুষকে ভালোবাসবার গান, দেশপ্রেম-মানবপ্রেম আর আত্মবোধন-জাগরণের সুরবাণী।