পঞ্চগড়ের মীড়গড়ের রসালো টোপা দেখলেই আপনার জিভে জল আসবে। চিনি অথবা গুড়ের রসে টইটুম্বুর এই টোপা খেতে যেমন স্বুসাদু তেমনি দেখতেও সুন্দর আর স্বাস্থ্য সম্মত। টোপার রয়েছে ইতিহাসও। তাই মীড়গড়ের রসালো টোপা পঞ্চগড়ের একটি ঐতিহ্যবাহী পিঠা জাতীয় খাবার হিসেবেই ইতিহাসে ঠাঁই করে নিয়েছে।
পঞ্চগড় শহর থেকে উত্তর পশ্চিমে করোতোয়া নদী বেষ্টিত গ্রাম মীড়গড়। যে পাঁচটি গড়ের সমাহারে জেলার নাম হয়েছে পঞ্চগড়, মীড়গড় তাদের মধ্যে একটি। সুপ্রাচীন এই গ্রামটিতে রয়েছে ছোট্ট একটি বাজার। ইতিহাস বলছে স্বাধীনতার বহু আগে মীরগড়ে আন্ধারী রানী নামের এক প্রবীণ নারী বসবাস করতেন। তিনি মজাদার এই মিষ্টি নিজ হাতে বানাতেন। পরে গ্রামে ঘুরে ঘুরে তা বিক্রি করতেন।
তিনিই রসাল এই মিষ্টির নাম দিয়েছিলেন টোপা। তখন প্রতিটি টোপা মাত্র দুই পয়সায় বিক্রি হতো। রাতের বেলা টোপা বানাতেন তিনি। আর ভোর বেলা মাটির পাত্রে টোপা নিয়ে গোটা গ্রাম ঘুরতেন। একসময় টোপার স্বাদের গল্প ছড়িয়ে পড়ে। মীরগড় ছাড়াও এর আশপাশের এলাকায় রসাল এই মিষ্টির ব্যাপক চাহিদা ছিল। ধীরে ধীরে মুখরোচক এই মিষ্টির কথা দূরদূরান্তে ছড়িয়ে পড়ে। বিভিন্ন জায়গা থেকে লোকজন মীরগড়ে টোপা খেতে আসতে শুরু করেন। খাওয়ার পাশাপাশি কিনেও নিয়ে যেতেন অনেকে।
মীরগড় সরকারি প্রার্থমিক বিদ্যালয়ের সহকারি শিক্ষক আতাউরি রহমান জানান, টোপা মুখে পুড়লেই রস আর গন্ধে অন্য রকম স্বাদ অনুভূত হবে।ইতিহাস টেনে তিনি বলেন, আন্ধারী রানীর কেউ এখন আর নেই। কিন্তু আন্ধারী রানীর কাছ থেকে টোপা বানানোর কৌশল শিখে নেন মীরগড়ের মোমিনপাড়ার দুখু মোহাম্মদ নামের এক ব্যক্তি। আন্ধারীর মৃত্যুর পর তিনি এই মিষ্টি বানানো শুরু করেন। স্বাধীনতার পর দুখু মারা যান। এর পর থেকে টোপা বানাচ্ছেন দুখুর ছেলে আজিজুল ইসলাম। ৪৩ বছর ধরে নিজের ছোট্ট দোকানে টোপা বিক্রি করছেন আজিজুল। আজিজুলের ছেলেও এখন বাপের সঙ্গে টোপা বিক্রী করছেন।
তিনি বলেন, টোপা শুধু একটি মিষ্টি নয়, এটি মীরগড় তথা পঞ্চগড়ের ঐতিহ্যের অংশ। টোপা বিক্রেতা আজিজুল ইসলাম জানান, বাবা টোপার দোকান করতেন । ছোটবেলা থেকেই বাবার সাথে দোকানে কাজ করতাম। এখন আমি নিজেই দোকান দিয়েছি। প্রতিটি টোপা বর্তমানে ১০ টাকা করে বিক্রি করি। টোপা খেতে আসছে পঞ্চগড় বেড়াতে আসা পর্যটকরাও। আশেপাশের বিভিন্ন উপজেলা এবং গ্রাম গঞ্জ থেকেও টোপা খেতে আসেন এখানে। অনেকে বাড়ি নিয়ে যান।
মীরগড় বাজারে গেলে দুই ধরনের টোপা পাওয়া যাবে। একটি চিনি দিয়ে বানানো, অন্যটি গুড়ের। একসময় টোপা বানানোর মূল উপকরণ ছিল চালের গুঁড়া আর ময়দা। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এতে পরিবর্তন এসেছে। এখন টোপা বানানো হয় ময়দা দিয়ে। শুরুর দিকে টোপার আকৃতি ছিল লম্বাটে। এখন সেটি হয়েছে গোলাকার।
প্রথমে ময়দার সঙ্গে পানি মিশিয়ে মণ্ড বানানো হয়। পরে সেটা ছোট গোল মিষ্টির আকার দেওয়া হয়। এরপর তেলে ভাজতে হয়। সবশেষে তেলেভাজা মণ্ডটা মিষ্টি চিনি কিংবা গুড়ের শিরায় (রস) ডুবিয়ে রাখতে হয়। মীরগড় বাজারে আরও কয়েকটি দোকানে এখন টোপা বিক্রি হয়।
মীরগড়ের এই ঐতিহ্য এখন পঞ্চগড় জেলার অন্যতম ব্র্যান্ড। জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে প্রকাশিত ২০২১ সালে পঞ্চগড় জেলা ব্র্যান্ডবুকে টোপার নাম উল্লেখ করা হয়েছে।
বিডি প্রতিদিন/হিমেল