অপেক্ষার প্রহর শেষ। মধ্য অক্টোবর থেকে কাঞ্চনজংঘা সৌন্দর্যের প্রাচুর্য নিয়ে অবারিতভাবে নিজেকে মেলে ধরলেও এবার বেশ কিছু দিন থেকেই হতাশ করছিল প্রকৃতি প্রেমিকদের। প্রকৃতির নানা খেলায় দেখা মিলছিল না এই পর্বতের। হতাশ হয়ে ফিরে যাচ্ছিলেন পর্যটকেরা। কিন্ত বুধবার থেকে আবার জেগে উঠেছে বরফ ঢাকা এই পর্বত।
হেমন্তের ছোঁয়ামাখা হিমালয়ের চাদর বিছানো সমতল অঞ্চল পঞ্চগড়ের মাঠজুড়ে ধান পাকা শুরু হয়েছে। আর ঠিক এই সময়ে হিমালয় কন্যা খ্যাত শীত প্রধান এই জেলায় অনুভূত হচ্ছে মধুর শীতের আমেজ। ভোর বেলায় কুয়াশা পড়ছে। ঝরছে শিশির বিন্দু। ধানের শীস বা ঘাসের উপর শিশির কণা মুগ্ধতা ছড়িয়ে যাচ্ছে। কুয়াশা আর শীতের আমেজে বিরাজ করছে মোহময় পরিবেশ। শরীর জুড়ে লাগছে হিমালয় থেকে বয়ে আসা হেমন্তের সুবাতাস। পৃথিবীর সর্ববৃহৎ পাহাড় হিমালয়ের বুক চিরে জেগে উঠছে পৃথিবীর তৃতীয় উচ্চতম শৃঙ্গ কাঞ্চনজংঘা। ভোর বেলা সূর্য ওঠার সাথে সাথে রূপ লাবণ্য ছড়িয়ে দিয়ে কাঞ্চনজংঘা সারা পঞ্চগড়ে এক মায়াময় আবেশ সৃষ্টি করছে।
পঞ্চগড়ের স্থানীয়রা সুদীর্ঘকাল ধরে সকালের ধোঁয়া ওঠা চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতেই উপভোগ করেন কাঞ্চনজংঘার রূপ। শরৎ, হেমন্ত আর শীত কালেই দেখা মেলে এই মহাশুভ্র নায়কের। কখনো কখনো বছরের অন্যান্য সময়েও আকাশের বুক চিরে উঁকি দেয়। ভোর থেকে আস্তে আস্তে নিজেকে মেলে ধরে এই শৃঙ্গ। হিমালয়ের স্নিগ্ধতা হাসি ছড়িয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। এক শক্তিমান প্রতিভূর মতো দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে হঠাৎ লুকিয়ে পড়ে মেঘের আড়ালে। আকাশ আর স্থলের দিগন্ত বিস্তৃত ক্যানভাসে যেন আঁকা ছবি। বাতাসে উড়তে উড়তে মেঘ সরে গেলে আবার জেগে ওঠে। ক্ষণে ক্ষণে রং বদলায়। আবার হারিয়ে যায়। মনে হয় কেউ যেন মুছে দেয় আঁকা সেই ছবি। প্রকৃতি আর কাঞ্চনজংঘা প্রেমিদের সাথে চলে লুকোচুরি খেলা। এই লুকোচুরির খেলায় দর্শকেরাও যোগ দেয়। আবার জেগে ওঠার অপেক্ষা করেন তারা। পর্যটকেরা চোখ বড় করে দূরে তাকিয়ে থাকেন। কখন দেখা মিলবে রহস্যময় এই পাহাড়ের? অপেক্ষা ছাড়া কোন উপায় থাকে না তখন।
তেঁতুলিয়া উপজেলার ডাকবাংলো এলাকা, মহানন্দা, ভেরসা,করোতোয়া, ডাহুক নদীর পাড় এবং বিভিন্ন গ্রাম থেকে সবচেয়ে ভালো উপভোগ করা যায় কাঞ্চনজংঘা। কাঞ্চনজংঘাকে বলা হয় সুপেয় পানির ঠিকানা। বরফের এই পাহাড় থেকে নেমে এসেছে চারটি নদী। এই নদীগুলো বয়ে গেছে পঞ্চগড়ের উপর দিয়ে। হিমালয় আর কাঞ্চনজংঘার জলের ধারাও বয়ে যাচ্ছে এই সমতলের মাটির গভীর দিয়ে। এজন্য এই এলাকার পানি বাংলাদেশের সর্বোৎকৃষ্ট সুপেয়। এই পানিকে মিঠা পানিও বলা হয়।
তবে সবসময় দেখা মেলে না সাদা শুভ্র এই পাহাড়ের। মেঘ আর কুয়াশা মাঝে মাঝেই আড়াল করে রাখে তাকে। তখন অপেক্ষা ছাড়া কোনও উপায় থাকে না। এ জন্য অনেকে বলে থাকেন কাঞ্চনজংঘা দেখার জন্য কপালও লাগে।
১৮৫২ সালের আগে পৃথিবীতে কাঞ্চনজংঘাকে সর্বোচ্চ শৃঙ্গ বলেই ধারণা করা হতো। বর্তমানে বিশ্বের তৃতীয় সর্বোচ্চ পর্বতচূড়া হিসেবে পৃথিবীতে স্থান করে নিয়েছে কাঞ্চনজংঘা। কাঞ্চনজংঘার উচ্চতা ৮ হাজার মিটার বা ২৬ হাজার ফুট। এই পর্বত চূড়ার মোহনীয় সৌন্দর্য দেখতে হাজার হাজার পর্যটক ভারত নেপাল ভ্রমণ করেন। পঞ্চগড়ে খালি চোখেই দেখা যায় এই পর্বত শৃঙ্গের অপরূপ সৌন্দর্য। কাঞ্চনজঙ্ঘার এই মনোমুগ্ধকর রূপ দেখতে পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়ায় ভীড় জমাচ্ছেন পর্যটকেরা। স্থানীয়রা বলছেন, কাঞ্চনজংঘা দেখা গেলে সারা দেশের পর্যটকরা ছুটে আসেন তেঁতুলিয়ায়। তখন একটি উৎসবের মতো পরিবেশ সৃষ্টি হয়। কাঞ্চনজংঘা, শীতের আমেজ আর কুয়াশা এখন পুরো পঞ্চগড়কে আবেশময় করে তুলেছে। কিন্তু বছর জুড়ে তেঁতুলিয়ায় পর্যটকের ভীর লেগে থাকলেও এখনো পর্যটন কেন্দ্রীক উন্নয়ন ঘটেনি। এ জন্য প্রয়োজন সরকারি বেসরকারি উদ্যোগ।
তেঁতুলিয়া বা পঞ্চগড় যাবেন কিভাবে ?
সড়ক পথে সরাসরি তেঁতুলিয়া যাওয়া আসা করতে পারবেন। রেলপথে পঞ্চগড়ে নেমে তারপর সড়ক পথে মাত্র ৫০ কিলোমিটার পেরিয়ে পৌঁছাবেন তেঁতুলিয়া। বাস, অটো, রিক্সা, ভ্যান পাবেন। ভাড়াও খুব বেশি নয়। বিমানে আসতে চাইলে সৈয়দপুর বিমানবন্দরে আসতে পারেন। তারপর সড়ক পথে তেঁতুলিয়া।
ঢাকা থেকে সরাসরি তেঁতুলিয়া যেতে চাইলে হানিফ, বুড়িমারি এক্সপ্রেস, নাবিল, হানিফসহ আরও বেশ কিছু বাস সরাসরি তেঁতুলিয়া যাতায়াত করে। এসি/নন এসি এসব বাসের ভাড়া জনপ্রতি ৯০০ থেকে ১৯০০ টাকা। ট্রেনে যেতে চাইলে ঢাকার কমলাপুর থেকে পঞ্চগড় এক্সপ্রেস, একতা ও দ্রুতযান এক্সপ্রেস ট্রেনে পঞ্চগড় যেতে পারবেন। ফিরতেও পারবেন এসব ট্রেনে। শ্রেণি অনুযায়ী ট্রেন টিকেটের ভাড়া জনপ্রতি ৬৯৫ থেকে ২৩৯৮ টাকা পর্যন্ত।
পঞ্চগড় থেকে তেঁতুলিয়ায় পথে সারাদিন নিয়মিত বিরতিতে লোকাল বাস চলাচল করে। বাসের টিকেটের মূল্য জনপ্রতি ৫০ থেকে ৬০ টাকা। পঞ্চগড় কেন্দ্রীয় বাসস্টেশন এবং চৌরঙ্গী মোড় থেকে পঞ্চগড়ের বিভিন্ন স্থান ঘুরে দেখার জন্য প্রাইভেট কার ও মাইক্রো ভাড়া করতে পারবেন। প্রাইভেট কার ও মাইক্রো রিজার্ভ করতে আনুমানিক ২০০০ থেকে ৩০০০ টাকা ভাড়া লাগবে। সারাদিন ঘুরতে পারবেন। ঘুরতে ঘুরতেই কাঞ্চনজংঘার স্মৃতি মেশাতে পারবেন নিজের অনুভূতির সঙ্গে। ঢাকা সৈয়দপুর রুটে ৪টি বিমান নিয়মিত চলাচল করছে। এগুলো হলো বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স, নভোএয়ার, রিজেন্ট এয়ার ওয়েজ, ইউ এস বাংলা এয়ার লাইন্স। চাইলে বিমানেও ভ্রমণ করতে পারেন।
কোথায় থাকবেন ?
তেঁতুলিয়ায় বেশ কিছু আবাসিক হোটেল গড়ে উঠেছে । রয়েছে সরকারি ডাকবাংলো। এসব হোটেলে নন এসি রুম ভাড়া ৬০০-৮০০ টাকা ও এসি ডাবল বেডের ভাড়া ১০০০-১৫০০ টাকা।
মহানন্দা নদী তীরের ডাকবাংলোতে থাকতে চাইলে তেঁতুলিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কাছ থেকে অনুমতি নিতে হবে। বন বিভাগের রেস্টহাউস এবং বাংলাবান্ধা স্থলবন্দরের জেলা পরিষদের ডাক বাংলোতে পূর্ব অনুমতি সাপেক্ষে থাকতে পারবেন। চাইলে পঞ্চগড় জেলা শহরেও রাত কাটাতে পারেন আরামসে। এই শহরে সাধারণ মানের আবাসিক হোটেলে ৬০০ থেকে ১০০০ টাকায় নন-এসি কক্ষে থাকতে পারবেন। ১০০০-১৫০০ টাকায় এসি কক্ষ ভাড়া করতে পারবেন।
কি খাবেন ?
তেঁতুলিয়ার খাবার হোটেলগুলোতে সুস্বাদু খাবার পাবেন। হাস, গরু, মুরগী, কবুতরের মাংস, বিরানী, সব পাবেন। স্থানীয় পেলকা শাক, রাসা শাক, সিদলের ভর্তা খেতে চাইলে আগেই জানাতে হয়।
শেষ কথা
তেঁতুলিয়া থেকে কাঞ্চনজংঘার দূরত্ব ১৬৫ কিলোমিটার। এমন সংবাদে কেউ বেড়াতে এলে কপাল ঘষে আর ভোরে ঘুম থেকে ওঠার সিদ্ধান্ত নিয়েই যাত্রা শুরু করবেন। তবে হাতে খুব বেশি সময় নেই। কাঞ্চনবাবুকে দেখতে হলে এখনই নেমে পড়ুন। যাত্রা শুভ হোক।
বিডি প্রতিদিন/নাজমুল