ভূমি জরিপে ভুল সংশোধনের ৪ লাখ মামলা ঝুলছে। এর মধ্যে ১ লাখ ৪০ হাজার মামলা বিচারাধীন পাঁচ বছরের বেশি সময় ধরে। আর গত পাঁচ বছরে প্রায় ১ লাখ মামলা নতুন করে যোগ হয়েছে জটের খাতায়। সুপ্রিম কোর্টের বিবরণী শাখার এক পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করে এমন তথ্যই মিলেছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এসব মামলার জট নিরসনে কার্যকর উদ্যোগ দেখা যায়নি। ১৩টি নতুন ল্যান্ড সার্ভে ট্রাইব্যুনাল ও ৫৪টি স্বতন্ত্র আপিল ট্রাইব্যুনাল গঠনের জন্য বিচারক ও সহায়ক কর্মকর্তা-কর্মচারীর পদ সৃজনের প্রস্তাবও আটকে আছে। ফলে দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে বিচারপ্রার্থীদের।
সুপ্রিম কোর্টের বিবরণী শাখার গত বছর ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত তথ্য অনুযায়ী, সারা দেশে ল্যান্ড সার্ভে ট্রাইব্যুনালগুলোতে ৩ লাখ ৮১ হাজার ৪৭০টি মামলা বিচারাধীন ছিল। এসব মামলার মধ্যে ১ লাখ ৪০ হাজার ১৭১টি মামলা ঝুলছে পাঁচ বছরের বেশি সময় ধরে। একই সঙ্গে ল্যান্ড সার্ভে আপিল ট্রাইব্যুনালগুলোতে বিচারাধীন রয়েছে ৮ হাজার ৫১১টি মামলা।
সারা দেশে বিআরএস জরিপ শুরু হয় ১৯৮৪ সালে। যেসব এলাকায় যখন শেষ হয়, সেসব এলাকায় দেখা দেয় নানা ধরনের ত্রুটি-বিচ্যুতি। অদক্ষ মাঠ কর্মকর্তা, কর্মচারীদের দুর্নীতি ও অবহেলায় ভুলে ভরা এসব ভূমি জরিপের খেসারত গুনতে হচ্ছে জমির মালিকদের। জরিপের পর্চা আর ম্যাপে হাজার হাজার ভুল। কারও জমি পর্চায় আছে তো ম্যাপে নেই। ম্যাপে আছে তো পর্চায় নেই। আবার ম্যাপে থাকলেও শত বছর ধরে যে চৌহদ্দিতে মালিক সম্পত্তি ভোগদখল করে আসছেন সেভাবে নেই। এ কারণে সৃষ্টি হয়েছে নানা রকমের বিরোধ। প্রথমে এসব বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য বিভিন্ন দেওয়ানি আদালতে মামলা হতো। এরপর সরকার স্টেট অ্যাকুইজিশন অ্যান্ড টেনান্সি অ্যাক্ট-১৯৫০-এর ১৪৫(এ) ধারা অনুযায়ী ২০১২ সালের ২৯ নভেম্বর সারা দেশে ৪২টি ভূমি জরিপ ট্রাইব্যুনাল স্থাপন করে। বর্তমানে দেশে ৫৮টি স্বতন্ত্র ল্যান্ড সার্ভে ট্রাইব্যুনাল রয়েছে দেশে। আইনে আপিল ট্রাইব্যুনালের কথা বলা থাকলেও দেশে একটিও স্বতন্ত্র ল্যান্ড সার্ভে আপিল ট্রাইব্যুনাল নেই। ২০২০ সালের অক্টোবরে হাই কোর্ট ৯০ দিনের মধ্যে ল্যান্ড সার্ভে আপিল ট্রাইব্যুনাল গঠনের নির্দেশ দেয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৫০ সালের রাষ্ট্রীয় অধিগ্রহণ ও প্রজাস্বত্ব আইনটি সর্বশেষ ২০২৩ সালে সংশোধন করে সরকার। আইন সংশোধনের আগে ল্যান্ড সার্ভে ট্রাইব্যুনালের রায়ের বিরুদ্ধে হাই কোর্টে রিট করতে হতো। আইন সংশোধন করে জেলা জজ পদমর্যাদার বিচারকদের আপিল ট্রাইব্যুনালের বিচারক হিসেবে দায়িত্ব দেওয়ার সুযোগ রেখে আইন সংশোধন করা হয়।
সূত্রের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালের রাষ্ট্রীয় অধিগ্রহণ ও প্রজাস্বত্ব আইন সংশোধনের পর ৫৪টি স্বতন্ত্র ল্যান্ড সার্ভে আপিল ট্রাইব্যুনাল স্থাপনের জন্য বিচারক ও সহায়ক জনবলের পদ সৃষ্টির প্রস্তাব আইন মন্ত্রণালয় থেকে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় মাত্র ২৬ জন জেলা জজসহ সহায়ক কর্মচারীর পদ সৃষ্টির প্রস্তাব অনুমোদন করে। এখন সেই প্রস্তাব আটকে আছে অর্থ বিভাগে। জানতে চাইলে ল্যান্ড সার্ভে ট্রাইব্যুনালের সাবেক বিচারক (বর্তমানে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন অনুষদে পিএইচডি অ্যধায়নরত) অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ভূমি জরিপের মামলাগুলোতে সরাসরি সাধারণ মানুষের সংশ্লিষ্টতা রয়েছে। এ কারণে এসব মামলা নিয়ে মানুষের আগ্রহ বেশি। তিনি বলেন, বর্তমানে জেলা জজরা অন্য মামলার পাশাপাশি ল্যান্ড সার্ভে আপিল ট্রাইব্যুনালের মামলা করছেন। ভূমি জরিপের বিরোধ নিষ্পত্তিতে স্বতন্ত্র আপিল ট্রাইব্যুনাল জরুরি। একই সঙ্গে মামলা বিবেচনায় বিভিন্ন জেলায় একাধিক ট্রাইব্যুনাল স্থাপন করতে হবে। মামলাজট কমাতে এর বিকল্প নেই বলে মনে করেন এই বিচারক।সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী মনজিল মোরসেদ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ভূমি জরিপের বিরোধ একটি জটিল বিষয়। তাই সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে এসব মামলা দ্রুত নিষ্পত্তিতে উদ্যোগ নিতে হবে। প্রতি জেলায় প্রয়োজনীয় সংখ্যক ট্রাইব্যুনাল ও আপিল ট্রাইব্যুনাল স্থাপন করতে হবে। তিনি বলেন, বিচারক ও সহায়ক জনবল নিয়োগে পদ সৃষ্টিতে বেশি সময় লাগলে মামলার জট আরও বাড়বে। এ জন্য সরকারকে বিশেষ ব্যবস্থায় দ্রুত এসব সমস্যার সমাধান করতে হবে।