লাত ও উজ্জা ছিল কুরাইশের দুই দেবতা। কুরাইশের লোকেরা ঘুমানোর আগে লাত ও উজ্জার পূজা করত।
(মুসনাদে আহমাদ, খণ্ড-৪, পৃষ্ঠা-২২২)
এ দুটির নামে কসম খেতো। হজের সময় তারা ‘মানাত’কে ঘিরে তাওয়াফ করত।
(মুজামুল বুলদান, ‘আল-উজ্জা’ ভুক্তি)
সুরা নুহের ভেতর যেসব মূর্তির কথা বলা হয়েছে আরবের বিভিন্ন গোত্র এগুলোর পূজা করত। ‘ওয়াদ্দ’ ছিল দুমাতুল জান্দালে বনি কালবের দেবতা। ‘সুওয়াআ’ ছিল হুজাইল গোত্রের দেবতা। মুরাদ ও বনি গাতফানের গোত্রগুলোর দেবতা ছিল ‘ইয়াগুস’।
‘ইয়াউক’ পূজিত হতো হামদান গোত্রে। ‘নাসর’ ছিল হিময়ারি জুল কালা গোত্রের উপাস্য। (সহিহ বুখারি, সংশ্লিষ্ট আয়াতের তাফসির) শামে পূজা করা হতো ‘বায়াল’-এর। (তাফসিরে বায়জাবি, সুরা সাফফাতের তাফসির)
মূর্তির নাম বিশ্লেষণ
লাত : আবদুল্লাহ ইবন আব্বাস (রা.) ও অন্যদের থেকে বর্ণিত হয়েছে যে লাত শব্দটি থেকে এটা নিষ্পন্ন, এর অর্থ হলো সংমিশ্রণ।
আরবে একজন লোক ছিল, লোকটি হজের মৌসুমে একটি পাথরের ওপর বসে থাকত এবং ছাতু গুলিয়ে গুলিয়ে হাজিদের মধ্যে বিতরণ করত। লোকটির মৃত্যুর পর মানুষ ওই পাথর পূজা শুরু করে দিল এবং এটির নাম রাখল লাত (মিশ্রণকারী)। (সহিহ বুখারি, তাফসির সুরা নাজম; ফাতহুল বারি)
আল-উজ্জা : আল-উজ্জা অর্থ হলো প্রতাপ, প্রতিপত্তি। এই শব্দের ইসমুত তাফজিল বা অগ্রাধিকার-বিশেষণ ও স্ত্রীলিঙ্গ হলো উজ্জা। অর্থাৎ মহাপরাক্রমশালী দেবী।
এতে বিস্ময়ের কিছু নেই যে উজ্জা কুরাইশ ও একই বংশীয় অন্যান্য গোত্রের যুদ্ধের দেবী ছিল। এ কারণেই হয়তো উহুদ যুদ্ধে মুসলমানরা পরাজিত হলে আবু সুফিয়ান পাহাড়ের ওপর থেকে চিৎকার করে বলেছিলেন : ‘আমাদের রয়েছে উজ্জা, তোমাদের তো উজ্জা নেই।’ তখন নবী করিম (সা.) কর্তৃক উমর ইবনুল খাত্তাব (রা.)-কে তার জবাব দিতে নির্দেশ দেওয়া হয়, যেন তিনি এই কথা বলেন—‘আল্লাহ আমাদের অভিভাবক এবং তোমাদের কোনো অভিভাবক নেই।’
(সহিহ বুখারি, গাজওয়াতু উহুদ)
মানাত : মানাত শব্দটি কয়েকটি মূল ধাতু থেকে নির্গত হওয়ার সম্ভাবনা রাখে। ‘লিসানুল আরব’ প্রণেতা উল্লেখ করেছেন যে মানাত-এর ‘তা’ স্ত্রীলিঙ্গবাচক। তাদের বিশ্বাস অনুযায়ী, মানাত ভাগ্য ও মৃত্যুর দেবী ছিল।
ওয়াদ্দ : ওয়াদ্দ অর্থ অনুরাগ ও ভালোবাসা। এর বিপরীতে ছিল ঘৃণা ও শত্রুতার দেবী, তার নাম ছিল নিকরা। ওয়াদ্দ দেবতার কথা বিভিন্ন শিলালিপিতে পাওয়া যায়।
সুওয়াআ : আরবি ভাষা সুওয়াআ শব্দটির মূল ধাতু পাওয়া যায় না। যার অর্থ যুগ।
ইয়াউক : যার অর্থ রুখে দেওয়া। এই মূর্তির পূজা করত ইয়ামানবাসীরা। তাদের মধ্যে প্রতীক হিসেবে ভবিষ্যত্বাচক ক্রিয়াপদের ব্যাপকতা ছিল।
ইয়াগুস : ইয়াউকের পদ্ধতি অনুযায়ী ইয়াগুসও একটি প্রতীক। এর অর্থ হলো ফরিয়াদ করা। সুতরাং ইয়াগুসের অর্থ হলো যে ফরিয়াদ শোনে এবং ফরিয়াদের প্রতিকার করে।
নাসর : নাসর একটি পরিচিত পাখি শকুন। আকাশে শকুন আকৃতি ধারণকারী একগুচ্ছ নক্ষত্রকে নাসর (ভেগা) বলা হয়। ভেগা নক্ষত্র একটি দেবতা হিসেবে দীর্ঘকাল পর্যন্ত সেমেটিক জাতিগোষ্ঠীগুলোর পূজা লাভ করেছে। বাবেলের অন্যতম দেবতা ছিল নাসরুক। ইদানীংকালে বাবেলে এই দেবতার মূর্তি উদ্ঘাটিত হয়েছে।
বায়াল : বায়াল সম্পর্কে আগেই বলা হয়েছে যে এই দেবতা শামের উপাস্য ছিল। এ প্রসঙ্গেই এটির উল্লেখ কোরআন মাজিদে রয়েছে। বায়ালের শাব্দিক অর্থ শক্তি। রূপকার্থে নেতা ও সর্দারকেও বায়াল বলা হয়। একইভাবে স্বামী অর্থেও বায়াল শব্দটি ব্যবহৃত হয়। কোরআন মাজিদে শব্দটি দ্বিতীয় অর্থে বহুবার ব্যবহৃত হয়েছে। আরবের একটি বিখ্যাত দেবতা ছিল হুবাল। হুবাল ছিল কুরাইশের সবচেয়ে বড় উপাস্য। হুবাল বায়ালেরই বিকৃতরূপ।
আরবের মূর্তি ইউরোপে
বিস্ময়কর ব্যাপার এই যে আরবের তাওহিদবাদীরাই প্রথমে ইউরোপীয় দেশগুলোতে একত্ববাদের আলো ছড়ান, একইভাবে আরবের জাহেলি যুগই ইউরোপের মূর্তিপূজাকালের শিক্ষক ছিল। আরব বণিকদের মাধ্যমে গ্রিসে, গ্রিস থেকে ইউরোপের অন্যান্য দেশে আরবের দেবদেবী ছড়িয়ে পড়ে। সেসব দেশের লোকেরা এসব মূর্তির সামনে সিজদাবনত হয়ে এগুলো উপাসনা করতে শুরু করে। কথিত আছে যে গ্রিক দেবী লেটো (জিউসের পত্নী খবঃড়) আরবের লাতেরই বিকৃতরূপ। একইভাবে হুবাল হার্মিস হয়েছে। হুবাল সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা এসেছে ‘মুজামুল বুলদান’ নামক গ্রন্থে। কিছু প্রাচ্যবিদ এ বিষয়ে পুস্তিকা রচনা করেছেন। (এনসাইক্লোপিডিয়া অব ইসলাম, খণ্ড-১, পৃষ্ঠা-৩৮০)