বিদায় নিতে চলেছে বাংলা ১৪৩১ সন। ৩১ একটি তাৎপর্যময় সংখ্যা। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বিশেষত পূর্বে ব্রিটিশ রাজত্বের অংশ ছিল এমন সব দেশে কাউকে সম্মানসূচক স্বাগত, বিদায় বা চিরবিদায় জানানোর জন্য সেনাবাহিনীর কামান থেকে ৩১ বার গোলা ছোড়া হয়। আমাদের স্বাধীনতা বা বিজয় দিবসে জাতীয় বীরদের সম্মানে দিনের প্রথম প্রহরে ৩১ বার কামানের গোলা নিক্ষেপ বা তোপধ্বনির রেওয়াজ রয়েছে। বাংলা ১৪৩১ সনে দেশের ক্রান্তিকাল অতিক্রমের জন্য প্রায় দেড় সহস্রাধিক মানুষকে প্রাণ বিসর্জন দিতে হয়েছে। অঙ্গহানি হয়েছে আরও বহু সম্ভাবনাময় তরুণ-তরুণীর। জাতির এসব সূর্যসন্তান নিঃসন্দেহে আমাদের হৃদয়ের গভীর থেকে কেবল ৩১ বার নয়, শতকোটিবার সম্মান পাওয়ার যোগ্য।
শুরু হচ্ছে বাংলা ১৪৩২ সন। ৩২ পরিপূর্ণতার প্রতীক। ৪টি আক্কেল দাঁত (উইজডম টিথ)-সহ মোট ৩২টি দাঁত উঠলেই একজন মানুষকে পরিপক্ব ও বাস্তব জ্ঞানসম্পন্ন মনে করা হয়। বাংলাদেশের জনগণের সামনে সম্ভবত এখন বড় প্রশ্ন, ৫৩ বছরে অনেক ছেলেখেলাই তো হলো, পরিপূর্ণতা আসবে কবে? বেশ ঝামেলা ও দুশ্চিন্তার ভিতর দিয়েই শুরু হচ্ছে বাংলা ১৪৩২ সন। পুরো পৃথিবীর আবেগ, অনুভূতি এমনকি বাঁচা-মরার প্রশ্ন শুনেও যেন ৩২ দাঁত বের করে হাসছে ইসরায়েল ও তাদের পৃষ্ঠপোষক আমেরিকা প্রশাসন। বিভিন্ন প্রচারমাধ্যমে ইসরায়েলিদের নিক্ষেপ করা বোমায় বেসামরিক ফিলিস্তিনিদের মৃতদেহের স্তূপ গড়ে ওঠা এবং শিশুদের অবাধে হত্যার নির্মম দৃশ্য ভেসে বেড়াচ্ছে। অথচ আরব বিশ্ব এক হয়ে এর প্রতিবাদ জানাতে পারছে না। পবিত্র কোরআনের সুরা আল কাহাফ এবং ইসলামি ও খ্রিস্টীয় লোককথায় আসহাবি কাহফ বা ঘুমন্ত সাত যুবক ও একটি কুকুরের কথা বর্ণিত হয়েছে। একাধিক বর্ণনা মতে, ২৫০ খ্রিস্টাব্দের দিকে খ্রিস্টানদের ওপর রোমান নিপীড়ন থেকে বাঁচতে বর্তমান তুরস্কের এফেসাস শহরের বাইরে একটি গুহায় লুকিয়ে ছিল এই সাত যুবক ও একটি কুকুর। প্রায় ৩০০ বছর পর তারা চলমান বিশ্বে আবির্ভূত হয়েছিল। বাংলা ১৪৩২ সনের শুরুর দিকে ফিলিস্তিনিদের অস্তিত্ব চিরতরে ধ্বংস হতে যাচ্ছে দেখেও সেই সাত যুবকের মতোই যেন ঘুমিয়ে আছে উপসাগরীয় অঞ্চলের সাত দেশ তথা বাহরাইন, কুয়েত, ইরাক, ওমান, কাতার, সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাত। বাংলাদেশের ধর্মপ্রাণ ও মানবতাবাদী প্রতিটি মানুষ এর প্রতিবাদ জানাচ্ছে। মধ্যপ্রাচ্য পরিস্থিতির আরও অবনতি হলে বা ইরান, লেবানন, ইয়েমেনসহ কিছু দেশ বা কিছু গোষ্ঠী যদি ইসরায়েলের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে যুদ্ধে নামে, তবে জ্বালানি তেলসহ নানা ক্ষেত্রে জটিলতার সৃষ্টি হবে, যার চড়া মূল্য দিতে হবে বাংলাদেশকেও। তাই বাংলা ১৪৩২ সন হতে পারে এক নতুন চ্যালেঞ্জের বছর।
ঐতিহ্যগতভাবে বাংলা নতুন বছরে এই উপমহাদেশের ব্যবসায়ীরা নতুন হালখাতা খুলে গ্রাহক ও অন্যান্য অংশীজনের সঙ্গে নতুন করে সখ্য ও অগ্রযাত্রা সূচনা করেন। সুদূর আমেরিকায় বসে আবারও নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ঠিক এই সময়টিকেই বেছে নিয়েছেন ব্যবসার নতুন হিসাব কসার জন্য। চীন, ভিয়েতনাম, বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে তার দেশ আমেরিকায় পণ্য আমদানির ক্ষেত্রে আকাশচুম্বী কর আরোপের ঘোষণা দিয়ে যেন বিশ্ববাসীর বুকে ড্রাম বা নববর্ষের ঢাকঢোল বাজিয়ে দেন এই প্রেসিডেন্ট। তাঁর ঘোষণায় ধস নামে আমেরিকাসহ নানা দেশে শেয়ার বাজারে। পরবর্তী সময়ে ৯০ দিনের জন্য আমদানির ক্ষেত্রে বর্ধিত কর স্থগিত রাখা হলেও এ বিষয়টিকে কেন্দ্র করে বাংলা ১৪৩২ সন অস্বস্তিতে ফেলতে পারে নতুন হালখাতা খোলা দেশের ব্যবসায়ীদের।
বাংলা ১৪৩১ সন শেষ হলো দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে সাড়া জাগানো বিনিয়োগ সম্মেলনের মধ্য দিয়ে। যে সময়ে সেনাবাহিনী ও সেনানিবাস উড়িয়ে দেওয়ার কথা বলে মব জাস্টিসকে উসকে দেওয়া হচ্ছে, ঠিক সে সময়ে একজন বিমান সেনার (বিমান বাহিনী অফিসার) ঘরে জন্ম নেওয়া ও সেনানিবাসে বেড়ে ওঠা এবং সেনাবাহিনী পরিচালিত স্কুল ও ক্যাডেট কলেজে পড়ালেখা করা আইকনিক চরিত্র ও বিনিয়োগ বোর্ডের কর্ণধার আশিক চৌধুরী ছিলেন এই বিনিয়োগ সম্মেলনের মূল কারিগর। সম্মেলনটিতে প্রায় ৫০টি দেশের সাড়ে ৫০০ প্রতিনিধি এবং অনলাইন ও মিডিয়ার কল্যাণে আরও বহু দেশের বিনিয়োগকারীরা বাংলা ১৪৩২ সনে প্রবেশকালে নতুন বাংলাদেশের বাস্তব চিত্রটা দেখার সুযোগ পেয়েছেন। বিভিন্ন দেশের উচ্চপর্যায়ের ব্যবসায়ীরা এ সময় ঢাকায় পদার্পণ করলেও বিমানবন্দর, রাস্তাঘাট বা সম্মেলন কেন্দ্রে তারা কোনো নেতা-নেত্রীর ছবি বা বিলবোর্ড দেখেননি। বরং দেখেছেন তৈরি পোশাক খাতের নারীকর্মী, প্রবাসী শ্রমিক কিংবা ফসল ফলানোর কৃষকের ছবি। দেশে তারুণ্যের অস্তিত্ব, শক্তি ও সম্ভাবনাই ছিল বিনিয়োগ সম্মেলনে আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু। তবে এ কথা ভুলে গেলেও চলবে না যে এই তরুণদেরই একটি অংশ আবার সম্মেলন চলাকালে বাটা, কেএফসি ও পিৎজাহাটের বিভিন্ন স্থাপনায় হামলা চালিয়েছে, যা নিশ্চয়ই সম্ভাব্য বিনিয়োগকারীদের চোখ এড়ায়নি। আরও মনে রাখতে হবে যে কেবল প্রশাসনিক জটিলতা, দুর্নীতি ও আমলাদের ব্যক্তিস্বার্থ চরিতার্থের তীব্র বাসনায় অতীতে বহু সম্ভাবনাময় বিনিয়োগের সম্ভাবনা অংকুরে বিনষ্ট হয়েছে। একজন আশিক মাসিক ভিত্তিতে বিনিয়োগকারীদের সকালের নাশতায় আমন্ত্রণ জানিয়ে বিষয়গুলো দেখার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, যা আশা-জাগানিয়া। আশিকের জন্য শুভকামনা।
১৪৩১ সনের শেষে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের চীন ও বিমসটেক সম্মেলন উপলক্ষে থাইল্যান্ড সফর ছিল একটি নতুন মাইলফলক। এ সময় চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং ও ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে সরাসরি বৈঠক ছিল বেশ তাৎপর্যপূর্ণ। ২-১ মাসের মধ্যে চীন সে দেশের বাণিজ্যমন্ত্রীর নেতৃত্বে ২০০ ব্যবসায়ীকে বাংলাদেশে পাঠানোর ঘোষণা দিয়েছে, যারা বাংলাদেশে বিনিয়োগে আগ্রহী। অন্যদিকে ‘নো কান্ট্রি উইশেস বাংলাদেশ ওয়েল মোর দেন আজ’ (কোনো দেশ বাংলাদেশের ভালো আমাদের চেয়ে বেশি কামনা করে না) মর্মে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর ঘোষণা করার দিনে ভারতের ভূখণ্ড ব্যবহার করে তৃতীয় কোনো দেশে বাংলাদেশি পণ্য রপ্তানির প্রচলিত সুযোগ বা ট্রান্সশিপমেন্ট কোনো ধরনের পূর্ব ঘোষণা ছাড়াই বন্ধ করে দেয়। তবে সেদিনই মধ্যরাত অবধি আলোচনা করে অচিরেই বিমানবন্দরের সক্ষমতা বাড়িয়ে এই সমস্যার সমাধানের সংকল্প ব্যক্ত করেন বাণিজ্য উপদেষ্টা আকিজ বশির। তাই আকিজ বশিরকেও সাধুবাদ।
তবে মনে রাখতে হবে, পৃথিবীতে সাধু আর অসাধুর অবস্থান থাকে একই দূরত্বে। নিজেদের সততা ও যোগ্যতার কারণেই আমরা সাধু বা অসাধু সান্নিধ্য পাই। চীনের ঋণে বহু দেশ সর্বস্বান্ত হয়ে একপ্রকার অর্থনৈতিক পরাধীনতা বরণ করতে বাধ্য হয়েছে। আশিকের কথা প্রতিধ্বনিত করে তাই বলা যায় ‘৩৬০ ডিগি’ বিবেচনা করে ফেলতে হবে ১৪৩২ সনের প্রতিটি পদক্ষেপ। ৩২টি দাঁতের পর আর কোনো দাঁত ওঠে না বরং ঝরে পড়তে থাকে। ১৪৩২ সনে দেশের সর্বক্ষেত্রে যে সুযোগ আসতে পারে, সেরকম সুযোগ আবার না-ও আসতে পারে। সবাইকে শুভ নববর্ষ
লেখক : গবেষক, বিশ্লেষক ও কলামিস্ট
ইমেইল : [email protected]