‘ছন্দে ছন্দে পদে পদে অঞ্চলের আবর্ত-আঘাতে উড়ে হোক ক্ষয় ধূলিসম তৃণসম পুরাতন বৎসরের যত নিষ্ফল সঞ্চয়।’
শতবছরের আগে বাঙালির কবি-সার্বভৌম নববর্ষকে আহ্বান জানতে গিয়ে যে অভিপ্রায় ব্যক্ত করেছিলেন এতকাল পরে এসেও বাঙালি নতুন বছরকে স্বাগত জানায় একই কামনাবাসনায়। কালের অন্তহীন প্রবাহে মিশে গেল বহমান বাংলার বাঙালির আরও একটি বছর। চলে গেলে ১৪৩১ বঙ্গাব্দ। এলো নতুন বছর ১৪৩২। নতুন বছরের প্রথম প্রভাতে আমরা নববর্ষকে আহ্বান করে আবারও উচ্চারণ করি :
‘ঐ নূতনের কেতন ওড়ে কালবোশেখীর ঝড়। তোরা সব জয়ধ্বনি কর!’
পুরোনো বছর চলে যায় কিন্তু রেখে যায় তার পদচিহ্ন। এ পদচিহ্নে থাকে ব্যক্তি ও সমাজজীবনের নানা ছবি, নানা গান যাতে থাকে বেদনা ও আনন্দের স্বাক্ষর, ব্যর্থতা, সফলতার খতিয়ান। ব্যর্থতার অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষাগ্রহণ করে সফলতায় উত্তরণের দীক্ষা গ্রহণ করে মানুষ নতুন বছরের প্রথম দিনে! এটা শুধু বাঙালির বেলায় সত্য নয়, বিশ্বের জাতিধর্মবর্ণনির্বিশেষে সবার ক্ষেত্রেই এ নিয়মের ব্যতিক্রম নেই। দেশ, জাতি, সমাজ, ব্যক্তিনির্বিশেষে সবারই বিগত বছরের দিনগুলোর সফলতা, ব্যর্থতার হিসাবনিকাশ প্রাপ্ত অর্জনকে নিয়েই নতুন বছরের মুখোমুখি হয়। এ অর্জনই নতুন বছরের পথ চলার সম্বল।
আজ চৈত্র শেষে যে বছরটি বিদায় নিতে যাচ্ছে, তা যতটা সাফল্যের তার চেয়েও বেশি ছিল ব্যর্থতার। দেশের সাধারণ মানুষ নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির মূল্যবৃদ্ধিতে ত্রাহি ত্রাহি রবে ব্যথিত করে তুলেছিল দেশের আকাশবাতাস। হত্যা-রাহাজানি-ধর্ষণ-ছিনতাই-সন্ত্রাস-জনজীবনকে দুর্বিষহ করে তুলেছিল। আতঙ্কের মধ্যেই কাটাতে হয়েছে তাদের গোটা বছর।
বছরের এমন বীভৎস রূপ, এমন দুর্বিপাক স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে এর আগে দেশের মানুষকে দেখতে হয়নি। সে ভয়াবহ চিত্র যদি নতুন বছরে দেখতে হয় তাহলে সেটা হবে জাতির জন্য দুর্ভাগ্য। মনুষ্যত্বের সাধনাই বাঙালির সর্বযুগের সাধনা। এ সাধনা ব্যাহত হোক বিঘ্নিত হোকÑ এটা কোনোকালেই এ দেশের মানুষ চায়নি। তাই এ দেশের সাধক কবির মুখে উচ্চারিত হয়েছে ‘সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই’। নতুন বছরে তাই, আমাদের প্রার্থনা-পুরোনো বছরের যত আবর্জনা-‘দূর হয়ে যাক, যাক, যাক’। আমাদের বিশ্বাস-ব্যর্থতার অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে, বিপর্যয়ের উৎস ও হেতু খুঁজে নিয়ে চলতে পারলে সাফল্য না এসে পারে না।
রবীন্দ্রনাথ নববর্ষকে ‘মনুষ্যত্ব লাভের দূর সাধনার’ জন্য সংকল্প গ্রহণের দিন বলে চিহ্নিত করেছিলেন। দেশে গত বছরে প্রতিদিন মনুষ্যত্বের চরম অবমাননা দেখা গেছে তাতে বিশ্বের কাছে দেশ ও জাতির মাথা হয়েছে হেঁট।
নতুন বছরে দেশের মানুষ এ বীভৎসতা থেকে মুক্তি চায়।
গত বছরটি ছিল আমাদের জন্য একটি বেদনাবহ। এ বছরে আমরা ছাত্র-জনতার স্বৈরতন্ত্র পতনের আন্দোলনে হারিয়েছি আমাদের অনেক সন্তানকে। হারিয়েছি তাদের যারা মনুষ্যত্বের সাধনায় ছিলেন অবিচল। এসব ব্যক্তিত্বের চিরপ্রস্থান বিদায়ি বছরটিকে আমাদের কাছে স্মরণীয় করে রাখবে সন্দেহ নেই। তবে তাদের শূন্যতা পূরণ হতে আরেকটা নতুন বছর প্রয়োজন হবে জানি না। তাই নববর্ষের আনন্দলগ্নেও আমরা ব্যথিতচিত্তে তাদের স্মরণ না করে পারছি না।
নতুন বছরের প্রথম দিন পয়লা বৈশাখ বাঙালির জাতীয় উৎসব। জাতীয় উৎসবের মধ্যে থাকে একটি জাতির আত্মার পরিচয়। এদিক দিয়ে বাংলা নববর্ষ উদ্যাপনে মেলার ভূমিকা অনন্য। মেলা মানেই জাতিধর্মবর্ণ-ধনী-দরিদ্রনির্বিশেষে সবার মধুর সম্মিলনী। তাই মেলার মূল কথা-
‘সবারে করি আহ্বান,
এসো উৎসুক চিত্ত এসো আনন্দিত প্রাণ।’
যুগ যুগ ধরে বাংলার মানুষ এ মিলনের সাধনাই যে করে গেছে, নববর্ষের মেলা তারই স্মারক।
আজকের পয়লা বৈশাখের আমাদের কামনা-মিলনের, ঐক্যের। ঔপনিবেশিক শাসকগোষ্ঠী যখন বাংলা ও বাঙালি সমাজ-সংস্কৃতি-জাতিসত্তার ওপর নানাভাবে হামলা চালিয়েছিল, নানা অজুহাতে সেদিন পয়লা বৈশাখ আমাদের অপশক্তির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর শক্তি দিয়েছিল। এ শক্তির মূল নিহিত ছিল আবহমান বাংলা ও বাঙালির ঐতিহ্য এবং উত্তরাধিকারকে বহন করে চলার সম্মিলিত অঙ্গীকার ও ঐক্যে। জাতীয় জীবনে বর্তমানের এক অপশক্তির প্রচ্ছায়া দেখা যাচ্ছে বলে মনে হয়। তাই এবারের নতুন বছরকে বরণ করতে গিয়ে আমাদেরও কামনা, যেকোনো ধরনের হীনতা-দীনতা থেকে জাতিকে মুক্ত করার জন্য মিলন ও ঐক্য। অশুভশক্তির বিরুদ্ধে সংগ্রামে মিলন ও ঐক্যের অঙ্গীকারই আমাদের নতুন বছরের প্রত্যাশা।
লেখক : প্রাবন্ধিক