জাতি মর্মাহত চিত্তে, বেদনাবিধুর হৃদয়ে অনুভূতির ক্যানভাসজুড়ে হতাশা, নিরাপত্তাহীনতা, অবক্ষয়, দারিদ্র্য ও দুর্নীতির অসহ্য যন্ত্রণার ছাপ নিয়ে অবাক বিস্ময়ে অবলোকন করছে আজকের রাজনীতিতে প্রবহমান দুটি ধারার কথা, বলা হচ্ছে সত্য কিন্তু চিন্তাচেতনা মননশীলতায় পৃথিবীর মধ্যে অনন্যসাধারণ বিচিত্র এই বাংলাদেশ, যেখানে রাজনীতিবিদদের কাছে রাজনীতির একমাত্র প্রতিপাদ্য বিষয় ক্ষমতা। দুর্নীতি, মূল্যবোধের অবক্ষয়, অনিশ্চয়তা, নিরাপত্তাহীনতা- এর সব দায়দায়িত্ব মূলত শাসকগোষ্ঠীর ঘাড়েই বর্তায়। কিন্তু বাংলাদেশে এর একটি সিংহভাগ দায়িত্ব সমুদ্রের উচ্ছ্বসিত জলোচ্ছ্বাসের মতো আছড়ে পড়ছে বিরোধী দলের ওপরও। তারা আঙ্গুল উঁচিয়ে দুর্নীতির বিরুদ্ধে, দারিদ্র্যকবলিত মানুষের পক্ষে, মূল্যবোধের অবক্ষয়ের বিপরীতে মাথা তুলে অকুতোভয়ে দাঁড়ানো তো দূরে থাক, টুঁ শব্দটি পর্যন্ত করছেন না। বরং ২০-দলীয় জোট ও তার শীর্ষনেত্রী দুর্নীতির প্রশ্নে মুখে কুলুপ এঁটে বসে থাকেন। তার প্রধান কারণ, সেই নৈতিক শক্তি তাদের নেই এই কারণে যে, যারা এই দুর্নীতির সঙ্গে দৃশ্যমান জড়িত- এর একটা আনুপাতিক অংশের পৃষ্ঠপোষকতা তারাও ভোগ করেন। দুর্নীতির প্রশ্নে বিরোধী দলের এই নির্লজ্জ নীরবতা শুধু আমাকে কেন, দেশবাসীকে, বিশেষ করে পাশ্চাত্যের গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রসমূহ- যারা একসময় তাদের প্রতি সহানুভূতিশীল ও সংবেদনশীল ছিলেন তারাও সহানুভূতি প্রদর্শন তো দূরে থাক, আস্তে আস্তে সন্তর্পণে মুখ ফিরিয়ে নিতে বাধ্য হয়েছেন। সম্প্রতি ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সফরকালে ২০-দলীয় জোট নেত্রী ভারতের সঙ্গে বিদ্যমান সমস্যা সমাধানের প্রশ্নে একটি শব্দ উচ্চারণ না করেও পুরোটা সময়ই সরকারের তীব্র সমালোচনা করে নির্বোধের মতো দুঃস্বপ্ন দেখেছিলেন নরেন্দ্র মোদির সহানুভূতি ও সমর্থন আদায়ের। মোদির সমর্থন আদায়ের দুঃস্বপ্নটি কল্পনার আবর্তে আনা আমি কেন, তার দলেরও অনেকে রাজনৈতিক নির্বুদ্ধিতার নামান্তর মনে করেন; দেশবাসী তো বটেই। তার সাম্প্রতিক ইউটার্নে জোট এমনকি দলের অভ্যন্তরেও তিনি প্রশ্নবিদ্ধ। ভারতীয় সাংবাদিকের কাছে তার প্রদেয় বক্তব্য ভারতের বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জন করা তো দূরে থাক, তিনি যে ক্ষমতার জন্য নৈতিকতার কোনো ধার ধারেন না- এটি আজ প্রতিষ্ঠিত সত্য।
সম্প্রতি নোয়াখালী আইনজীবী সমিতির সঙ্গে মতবিনিময়কালে খালেদা জিয়া লজ্জা-শরমের মাথা খেয়ে বলেছেন, দেশে গণতন্ত্র তো নাই-ই, বরং সুকৌশলে শেখ হাসিনা রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করছেন। তার ওই বক্তব্যের প্রতিক্রিয়ায় চ্যানেল আইয়ের তৃতীয় মাত্রায় বেগম জিয়াকে বলেছিলাম, বিবেকের আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের চেহারাটি অবলোকন করুন। এই নিবন্ধেও আমি বলতে চাই, তার বিবেক, মূল্যবোধ সম্পূর্ণ নিঃশেষিত না হলে তিনি নিজেই লজ্জিত হবেন। ২০০১-এর নির্বাচনে কোন আন্তর্জাতিক শক্তি সুপরিকল্পিত কূটকৌশলে তাকে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত করেছিল অবধারিতভাবে সেই প্রশ্নটি এসে যায়। ২০০৬-এর নির্বাচনটি করতে পারলে আজকের আওয়ামী লীগের স্বেচ্ছাচারিতা ও অগণতান্ত্রিক মানসিকতার চেয়েও বেগম জিয়া যে আরও উদগ্রভাবে নিজেকে তুলে ধরতেন তাতে মানুষের কোনোই সন্দেহ নেই। অন্যদিকে ক্ষমতাসীন দলের শীর্ষ নেত্রী তো বটেই, তার পারিষদবর্গও নিশ্চিত ধরে নিয়েছেন যে, ২০৪১ সাল পর্যন্ত তারা পাকাপোক্তভাবে ক্ষমতায় থাকবেন। কেউ তাদের টলাতে পারবে না। এই বিষয়ে টকশো তৃতীয় মাত্রা'য় আমি বলেছিলাম, যে খুঁটির জোরে তারা এতখানি দম্ভোক্তি করছেন সেই আশীর্বাদটি অক্ষুণ্ন থাকলে ৪১ কেন, পুরো শতাব্দীতেই অলৌকিক কোনো ঘটনা না ঘটলে তাদের ক্ষমতা থেকে অপসারিত করা প্রায় দুঃসাধ্য।
মানুষের ভোটাধিকার চাওয়ার প্রাক্কালে দেশের রাজতন্ত্র, পরিবারতন্ত্র ঠেকানোর দাবির প্রেক্ষাপটে বিএনপির কাছে আমার সুস্পষ্ট দাবি- আপনারা সংগঠন ও জোটের অভ্যন্তরে গণতন্ত্রের মানসিকতা ও মননশীলতা তৈরি করুন। গণতান্ত্রিকতার স্বার্থে আপনাদের আন্দোলন, এটির যথার্থতা প্রমাণের জন্য অবশ্যই বেগম খালেদা জিয়ার কাছ থেকে এই অঙ্গীকার ব্যক্ত করা প্রয়োজন যে, তিনি ও তার পরিবার রাজনীতি থেকে সত্যিকার অর্থে অবসর নেবেন। অনিবার্যভাবে এখানে উল্লেখ্য, সত্যিকার গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে হলে শেখ হাসিনাকেও এরূপ ঘোষণা দিতে হবে। এখানে পাঠকের অবশ্যই মনে আছে, ২০০৮-এর নির্বাচনের পর শেখ হাসিনা রাজনীতি থেকে অবসর নেবেন- এরকম একটি ঘোষণা দিয়েছিলেন। কিন্তু জাতির পোড়া কপাল, দলের নেতৃত্ব তো বটেই, জোট, সাংবাদিক, শিক্ষক, বুদ্ধিজীবী, সুশীল সমাজ পরিবারতন্ত্রের কবল থেকে মুক্তি চাইলেও প্রকাশ্যে এটি উচ্চারণ করতে কেউই সাহস পাচ্ছেন না।
দুটি জোটের অভ্যন্তরেই অনেক দলের সমাহার কিন্তু আশ্চর্যজনক হলেও এটিই বাস্তব- উভয় জোটেই মস্কো-পিকিং, বাম-ডান, প্রগতিশীল-প্রতিক্রিয়াশীল মিলেমিশে একাকার হয়ে আছে শুধু স্বীয় স্বার্থ চরিতার্থ করার অভিলাষে। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে কী রাজ্য, কী কেন্দ্রীয় সব নির্বাচনের প্রাক্কালে প্রায়ই জোট গঠিত হয়। কিন্তু বাংলাদেশের মতো দলীয় নীতি-আদর্শ ও কর্মসূচি বিবর্জিত হয়ে নয়। ভারতসহ পৃথিবীর বিভিন্ন গণতান্ত্রিক দেশে জোটের ভিতরে তাদের নিজস্ব আঙ্গিকে আলোচনার তোলপাড় হয়।
এমনকি যুক্তরাজ্যে আমরা দেখেছি, দলের সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে বাঙালি এমপি রুশনারা আলী ছায়া মন্ত্রিসভা থেকে ইস্তফা প্রদান করেছেন। আর বাংলাদেশের জোটবদ্ধ দলগুলো দুই নেত্রীর শুধু বন্দনা অর্চনাই নয়, তাদের লালিত বিশ্বাসকেও নিঃসংকোচে বর্জন করে। বিএনপি থেকে অভিযোগ ওঠে আওয়ামী লীগ ভারতপন্থি দল। কিন্তু খালেদা জিয়া ক্ষমতার প্রলোভনে আকস্মিক ভারতের কাছে আত্দসমর্পণ করে ইউটার্ন নিলেন। ২০-দলীয় জোটের কট্টর ভারত-বিদ্বেষীরাও তখন টুঁ শব্দটি করেননি। ঘুণেধরা এ রাজনীতি শুধু ক্ষমতার পালাবদলের নাগরদোলা বলেই জনগণ রাজনীতি ও রাজনীতিকদের থেকে সঙ্গত কারণেই মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। তারা শুধু নির্বিকারই নয়, রীতিমতো বীতশ্রদ্ধ। এখানে প্রসঙ্গক্রমে আমি বলতে চাই, এই দুই জোটের বাইরে থাকা সাংগঠনিক শক্তি-বিবর্জিত কিছু প্রথিতযশা ব্যক্তিত্ব আছেন। তারা প্রায়ই বলেন, পেশিশক্তি ও অর্থের কাছে রাজনীতি বন্দী হয়ে আছে। তবুও তারা সাহস করে বলেন না- রাজনীতিই আজ পুঁজিবিহীন এবং সবচেয়ে ঝুঁকিবিমুক্ত লাভজনক ব্যবসা। এই কথাটি আমি সবসময়ই বলে আসছি। এই তৃতীয় পক্ষের রাজনীতিকরা বুদ্ধিদীপ্ত, জ্ঞানগরিমায় ভরপুর কিন্তু তাদের সাহসের প্রশ্নে তারা হতদরিদ্র। যার ফলশ্রুতিতে দেশে সফল গণতান্ত্রিক আন্দোলন গড়ে ওঠার কোনো সম্ভাবনাই সৃষ্টি হচ্ছে না। এটাও জাতি হিসেবে আমাদের জন্য অত্যন্ত বেদনাদায়ক।
মানুষ সবকিছুতেই আজ নির্বিকার। তার কারণ, শেখ হাসিনাকে সরিয়ে বেগম খালেদা জিয়াকে ক্ষমতায় বসাতে তারা নারাজ। যখন শুনি, উভয়েই বলেন- ক্ষমতার জন্য নয়, জনগণের জন্য রাজনীতি করি, তখন মানুষ একে কেবল সত্যের অপলাপই মনে করে না, মনে করে রাজনৈতিক কৌতুক করা হচ্ছে। প্রসঙ্গত আমি ক্ষমতাসীন শীর্ষ নেত্রীকে উদ্দেশ করে বলতে চাই, আপনি বলেছেন- ফরমালিন দিয়ে ওদের (বিএনপি) বাঁচিয়ে রেখেছি। আমি বলি ওরা নিষ্প্রভ। বিরোধী জোটের পক্ষে সাংগঠনিকভাবে একটা ফলপ্রসূ আন্দোলন গড়ে তোলা অসম্ভব। তাই প্রতিটি কথনে, ভাষণে বা বিবৃতিতে বিরোধী জোটের প্রতি ক্ষমতাসীনদের আস্ফালন আজ নিরর্থক ও অপ্রয়োজনীয়। বরং ক্ষমতাসীন জোট এবং শীর্ষনেত্রীর সর্বশক্তি নিয়োজিত হওয়া উচিত দুর্নীতি ও মূল্যবোধের অবক্ষয় রোধে। এর জন্য কোনো মহাবিপ্লবের বিরাট আয়োজনের প্রয়োজন নেই। প্রয়োজন সদিচ্ছা, প্রত্যয় ও প্রতীতির। আমি বঙ্গবন্ধুর আদর্শকে সব মননশীলতায় লালন করি বিধায় এই প্রত্যয় ও প্রতীতি শেখ হাসিনার কাছ থেকে দাবি করতে পারি। কোনো মানুষই ভুল-ত্রুটির ঊর্ধ্বে নয়। ভুল স্বীকার ও তা সংশোধনের চেষ্টা করা লজ্জার কিছু নয়। দুর্নীতির মূল ও শীর্ষ হোতা কারা সেটা তার অজ্ঞাত নয়। শুধু জাতি ব্যথিত এই কারণে যে, তাদের শাস্তি তো হয়ই না, বরং তাদের দোর্দণ্ড প্রতাপে দেশের আইনের শাসন আজ বিধ্বস্ত। প্রশাসনের শৃঙ্খলা আজ চূর্ণ-বিচূর্ণ। এক বছরেও নারায়ণগঞ্জের সাত খুনের আসামি নূর হোসেনের বিরুদ্ধে চার্জশিট দেওয়া হয়নি। এর দায়ভার সরকার এড়াবে কীভাবে? প্রাসঙ্গিকভাবেই বলতে হয় এই সিয়াম সাধনার মাসে বাজারের ফল-মূল, শাকসবজি, মাছ-মাংস এমনকি শিশুখাদ্যে ক্ষতিকারক রাসায়নিক ব্যবহার এবং নকল ওষুধে বাজার সয়লাব। মানব পাচার থেকে শুরু করে হাসপাতালসহ প্রশাসনের সব ক্ষেত্রে দালালদের অপ্রতিরোধ্য দৌরাত্দ্য এতটাই বল্গাহীন যে, মানুষ আজ দিশাহারা। এমনকি আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার একটা বিরাট অংশ রক্ষক হয়ে ভক্ষকের ভূমিকায় অবতীর্ণ। নিরীহ জনগোষ্ঠীর একটা বিরাট অংশ সদাসন্ত্রস্ত- তার ছেলেটিকে যেকোনো সময়ে গ্রেফতার করে মুক্তিপণ না দিলে জঙ্গি ও সন্ত্রাসী বানিয়ে তার ভবিষ্যৎকে চিরতরে বিকলাঙ্গ করে দেওয়া হবে। আমি নিষ্কণ্টক ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত ক্ষমতাসীন জোটকে বলতে চাই, দুর্নীতি ও মূল্যবোধের অবক্ষয়ের বিরুদ্ধে জরুরি ব্যবস্থা না নিলে অবস্থা যে ক্রমাগতই নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে। সম্প্রতি সন্ত্রাস ও বিরোধী জোটের বিক্ষোভ দমনে পুলিশের জন্য বিশাল অস্ত্রভাণ্ডার গড়া হয়েছে। অথচ মানব পাচারকারী, দেশের অর্থনীতিকে ধ্বংসকারীরা, শীর্ষ দুর্নীতিবাজরা এই শক্তিধর পুলিশের আওতার বাইরে কেন? খাদ্যদ্রব্যে রাসায়নিক মিশ্রণ শনাক্ত করার জন্য পর্যাপ্ত যন্ত্রপাতি আমদানি ও প্রশাসনের সৎ ও দক্ষ কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে অনতিবিলম্বে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হোক। এই পদক্ষেপ গ্রহণের সঙ্গে সঙ্গে এসব অবক্ষয়ের বিরুদ্ধে জনগণ সক্রিয়ভাবে এগিয়ে আসবে- এ ব্যাপারে আমি নিঃসংশয়চিত্ত।
মানুষকে উদ্বেলিত করার সুবর্ণ সুযোগটি ক্ষমতাসীনরা অবশ্যই কাজে লাগাবে বলে আমি প্রত্যাশা করি। সরকারের শীর্ষ নেতৃত্ব থেকে শুরু করে সবার বোধগম্য হওয়া উচিত- দুর্নীতি, অবিচার, আইনের সঠিক প্রয়োগের অভাবে দেশ ও জাতি দীপ্তিহীন আগুনের নির্দয় দহনে আজ তিলে তিলে দগ্ধ হচ্ছে।
লেখক : স্বাধীন বাংলা ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের অন্যতম নেতা।