বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনী, রাষ্ট্রের একটি প্রধান নিরাপত্তা বাহিনী হিসেবে, শুধুমাত্র একটি সামরিক প্রতিষ্ঠান নয় বরং জাতীয় অস্তিত্বের এক অপরিহার্য প্রতীক। এর মূল চেতনা বাংলাদেশের নিজস্ব জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে গঠিত—একটি চেতনা যা শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের স্বাধীনতার ঘোষণা ও মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে প্রাণ পেয়েছিল। এই সশস্ত্র বাহিনী আত্মপ্রত্যয়ী, গণমুখী এবং সর্বোপরি একটি জাতীয় চেতনায় বিশ্বাসী প্রতিষ্ঠান, যা দেশপ্রেম, ত্যাগ ও কর্তব্যবোধকে শ্রেষ্ঠ আদর্শ হিসেবে ধারণ করে আসছে।
বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর শিকড় মূলত গাঁথা জাতীয়তাবাদী চেতনার মাটিতে। ১৯৭১ সালের রক্তাক্ত স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে, সশস্ত্র বাহিনীর আত্মপ্রকাশ একটি স্বাধীন জাতিসত্তার স্বপ্ন বাস্তবায়নের সংগ্রামের অংশ ছিল। সেই ঐতিহাসিক মুহূর্তে শহীদ জিয়াউর রহমানের স্বাধীনতার ঘোষণা একটি রাজনৈতিক ঘোষণার চেয়েও অধিক ছিল—এটি ছিল জাতীয় চেতনার মশাল, যা হাজার হাজার তরুণ - যুবককে যুদ্ধে উদ্বুদ্ধ করে।
এই স্বাধীনতা যুদ্ধের ভিতর থেকেই যে সশস্ত্র বাহিনী গড়ে উঠেছে, তার বৈশিষ্ট্য হয়ে দাঁড়িয়েছে একটি বিশ্বাস—বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব, জনগণের অধিকার এবং রাষ্ট্রের স্বাধীনতা রক্ষায় সর্বোচ্চ আত্মত্যাগে প্রস্তুত থাকা। এই চেতনা বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনীকে অন্য অনেক দেশের বাহিনীর তুলনায় আলাদা পরিচয় দিয়েছে।
সশস্ত্র বাহিনীর একটি বড় শক্তি হলো তাদের জনগণের সঙ্গে নিবিড় সম্পর্ক। প্রাকৃতিক দুর্যোগ হোক বা জাতীয় সংকট—বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনী সর্বদা জাতির পাশে থেকেছে। ১৯৯৮ সালের ভয়াবহ বন্যা, ২০০৭ সালের ঘূর্ণিঝড় সিডর কিংবা সাম্প্রতিককালের কোভিড-১৯ মহামারির সময় সশস্ত্র বাহিনী তাদের দক্ষতা ও ত্যাগের মাধ্যমে জনগণের আস্থা অর্জন করেছে।
শান্তিরক্ষী মিশনে অংশগ্রহণের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলেও বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনী দেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করেছে। জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী বাহিনীতে বাংলাদেশ শীর্ষস্থানীয় অবদানকারী দেশ, এবং এই ভূমিকায়ও সশস্ত্র বাহিনী তার জাতীয়তাবাদী চেতনাকে বহির্বিশ্বে উপস্থাপন করছে।
বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর প্রতিটি সদস্য দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে কাজ করেন। দেশের প্রয়োজনে তাদের প্রতিশ্রুতি শুধু পেশাগত দায়িত্বের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়—এটি একটি আধ্যাত্মিক দায়িত্বও বটে। ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি’—এই জাতীয় গানের সুরে যেন তাদের হৃদয়ে প্রতিধ্বনিত হয় দেশপ্রেমের চিরন্তন আহ্বান।
তারা বিশ্বাস করেন, দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষাই সর্বোচ্চ কর্তব্য। সেই কারণেই সীমান্তে কাঁটাতারের ধারে হোক কিংবা গভীর সমুদ্রে কিংবা জাতিসংঘ মিশনে সুদূর আফ্রিকায়—বাংলাদেশের পতাকা তুলে ধরতে গিয়ে তাদের আত্মত্যাগ অক্লান্ত ও নির্বিচারে।
বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনী একটি আদর্শ-ভিত্তিক বাহিনী। এই বাহিনীকে কোনো বিদেশি আধিপত্যবাদ, আঞ্চলিক আগ্রাসন বা মতাদর্শিক বিভাজনের মাধ্যমে বশ করা সম্ভব নয়। ইতিহাসে বহুবার এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে যেখানে বাহিনীকে দুর্বল করার অপচেষ্টা হয়েছে—কিন্তু তাদের জাতীয়তাবাদী চেতনা এবং পেশাদারিত্ব তাদের সেইসব চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় দৃঢ় রেখেছে।
বিশ্ব রাজনীতির জটিলতায় কিংবা দেশীয় অস্থিরতায় বারবার এই বাহিনী দেখিয়েছে, তারা দেশের জনগণ ও সংবিধানের প্রতি অনুগত। তারা কখনোই ব্যক্তিগত বা গোষ্ঠীগত স্বার্থে ব্যবহৃত হতে আগ্রহী নয়, যদিও ইতিহাসে এমন কিছু দুঃখজনক উদাহরণ রয়েছে যেখানে অপশক্তির কারণে সশস্ত্র বাহিনীকে বিতর্কিত করার অপচেষ্টা হয়েছে।
অতীতে রাজনৈতিক অস্থিরতা বা কর্তৃত্ববাদী সরকারের সময় সশস্ত্র বাহিনীকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহারের অপচেষ্টা হয়েছে। এই ঘটনাগুলো শুধু সশস্ত্র বাহিনীর চেতনার বিরোধীই নয়, বরং দেশের সার্বিক নিরাপত্তার জন্যও হুমকি। তবে আশার বিষয় হলো, বর্তমান সশস্ত্র বাহিনী এই অপচেষ্টাগুলোর বিরুদ্ধে সচেতন এবং নিজেদের পেশাদারিত্ব বজায় রাখার ব্যাপারে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ।
এখন সময় এসেছে অতীতের ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে সশস্ত্র বাহিনীর স্বাধীন ও নিরপেক্ষ চরিত্র রক্ষায় সচেতন থাকার। গণতন্ত্রের প্রাতিষ্ঠানিক উন্নয়নে একটি পেশাদার সশস্ত্র বাহিনীর গুরুত্ব অপরিসীম।
আজকের বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনী প্রযুক্তিগত উৎকর্ষ, আধুনিক কৌশল এবং প্রশিক্ষণে বিশ্বমানের এক শক্তিশালী বাহিনী। তবে তাদের সবচেয়ে বড় শক্তি সেই চেতনা, যা ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে রোপিত হয়েছিল। জাতীয়তাবাদ, আত্মত্যাগ এবং জনগণের পাশে থাকার অঙ্গীকার আজো তাদের চালিত করে।
ভবিষ্যতের দিকে তাকালে দেখা যায়, বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনী কেবল দেশের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে না—তারা আরও বৃহত্তর ভূমিকায় অবতীর্ণ হবে। যেমন, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা, অবকাঠামো নির্মাণ, সামাজিক উন্নয়ন এবং আন্তর্জাতিক শান্তি প্রতিষ্ঠায় আরও সক্রিয় অংশগ্রহণ।
বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনী আমাদের জাতির গৌরব। তাদের শিকড় জাতীয়তাবাদে গাঁথা, তাদের আদর্শ দেশপ্রেমে রঞ্জিত, এবং তাদের পথ চলা আত্মবলিদানের আলোকবর্তিকা ধরে। এই বাহিনীর প্রতি আমাদের আস্থা, শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা যেন কখনোই ক্ষুণ্ণ না হয়। রাজনৈতিক বিভাজন কিংবা স্বার্থান্বেষী চক্রান্ত থেকে এই প্রতিষ্ঠানকে রক্ষা করা প্রতিটি নাগরিকের দায়িত্ব।
আমরা বিশ্বাস করি, ভবিষ্যতেও বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনী জাতীয় চেতনার প্রতীক হয়ে, জনগণের পাশে থেকে, দেশের সার্বভৌমত্ব, স্বাধীনতা এবং গৌরব রক্ষায় আত্মনিবেদিত থাকবে। কেননা এই বাহিনী কেবল একটি প্রতিষ্ঠান নয়, এটি একটি জাতির স্বপ্ন, সংগ্রাম ও স্বাধীনতার উত্তরাধিকার।
লেখক : সাবেক সেনা কর্মকর্তা ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক।