ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির কাবুল সফরের দিন যত এগিয়ে আসছে, সে দেশে বিস্ফোরণের ঘটনা তত বাড়ছে বলে মনে করছে সাউথ ব্লক। পাশাপাশি সোমবারের তালেবানি অন্তর্ঘাতের পিছনে ইসলামাবাদের ভূমিকা স্পষ্ট বলে মনে করছে নরেন্দ্র মোদির গোয়েন্দা সংস্থা। চলতি বছরের শেষে আফগানিস্তানের নতুন সংসদ ভবন উদ্বোধন করতে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির কাবুল সফরে যাওয়ার কথা। ওই ভবনটি তৈরি করছে ভারতই। কিন্তু তার আগে কাবুলের বর্তমান সংসদ ভবনে (যা নির্মীয়মাণ নতুন ভবনটির কাছেই) তালেবানি হামলার ঘটনা যথেষ্ট উদ্বেগ তৈরি করেছে সাউথ ব্লকে। শুধু সোমবারের বিস্ফোরণই নয়, আশরাফ ঘানির জমানায় আফগানিস্তানে যে লাগাতার হামলা চলছে তার পিছনে বর্তমান আফগানিস্তান সরকারের ভ্রান্ত পাক-নীতিই দায়ী বলে মনে করছে নয়াদিল্লি। গত বছর ক্ষমতায় আসার পর ঘানি পাকিস্তানের সঙ্গে যেভাবে সর্বাত্মক সম্পর্ক স্থাপনে উৎসাহ দেখিয়েছিলেন তা তার সরকারের পক্ষেও হারাকিরির শামিল হয়েছে বলেও মনে করছে দিল্লি।
প্রেসিডেন্ট হওয়ার পরদিন থেকেই ঘানি যেভাবে ইসলামাবাদ-কাবুল সম্পর্ক পুনরুদ্ধারে ব্রতী হয়েছিলেন তাতে সিঁদুরে মেঘ দেখেছিল নয়াদিল্লি। ঘানির ধারণা ছিল, তালেবানিদের আলোচনা এবং দর কষাকষির টেবিলে বসাতে পাকিস্তান সম্পূর্ণ সহযোগিতা করবে। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে তালেবানি হামলা ক্রমশ তীব্র হচ্ছে। কাবুলের ‘হাই সিকিউরিটি জোন’-কে যেভাবে নিশানা করা হচ্ছে তা আগে হয়নি। আফগানিস্তানের উত্তরাঞ্চল কার্যত রণক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে। আতঙ্ক এতটাই যে সীমান্তবর্তী তাজাকিস্তান, তুর্কমেনিস্তান, উজবেকিস্তানের রক্তচাপ বেড়ে গেছে। সব মিলিয়ে তালেবানদের হিংসাত্মক মনোভাবকে নিষ্ক্রিয় করতে পাকিস্তানের সদিচ্ছার কোনো পরিচয় কিন্তু এখনো পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে না। ঘটনা হলো, পাকিস্তানের উপজাতি এলাকায় তালেবানদের গোপন ঘাঁটির সংখ্যা খুব কম নয়। কাবুলে বড় মাপের জঙ্গি হামলাগুলোর পিছনে রয়েছে যে হাক্কানি নেটওয়ার্ক, তা পাকিস্তানেরই একটি অংশের মদদপুষ্ট। ঘানির উদ্দেশ্য ছিল ইসলামাবাদের সঙ্গে সখ্য তৈরি করে এই জঙ্গি নেটওয়ার্ককে খতম করা। কিন্তু বিষয়টি যে কাকস্য পরিবেদনা তা এখন বুঝতে পারছেন খোদ প্রেসিডেন্টই। কিন্তু কূটনৈতিক বিশেষজ্ঞদের মতে ঘানির এখন আর বিশেষ কিছু করার নেই। সাউথ ব্লকের এক কর্তার কথায়, ‘আফগানিস্তানের প্রতি ইসলামাবাদের যে ঔপনিবেশিক মানসিকতা, তা কখনোই বদল হবে না। আফগানিস্তানের জমি কৌশলগতভাবে দখল করে রাখার পিছনে পাকিস্তানের ভারতবিরোধী মনোভাব অনেকটাই ক্রিয়াশীল। এটা পাকিস্তান সেনা এবং আইএসআই-এর কৌশলগত সংস্কৃতির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে যুক্ত।’ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সূত্রের মতে, এটা ঘটনা যে পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি ও সমাজনীতিতে নিজেদের অবস্থান সুদৃঢ় রাখতে পাকসেনার কাছে কট্টর ভারত-বিরোধিতার মতো ভালো অস্ত্র আর নেই। তাছাড়া ভারতকে লালচোখ দেখিয়ে আলোচনার রাস্তায় আনা ইসলামাবাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতির মধ্যে পড়ে। ফলে ঘানির মুখ চেয়ে তালেবান ঘাঁটি ধ্বংস করা তাদের কাছে আত্মহত্যারই শামিল। কূটনৈতিক শিবির মনে করছে, চোর পালানোর পর বুদ্ধি বেড়েছে আফগান প্রেসিডেন্টের। প্রবল অভ্যন্তরীণ চাপের মুখে তিনি সম্প্রতি ইসলামাবাদ সম্পর্কে সুর কিছুটা চড়া করতে বাধ্য হয়েছেন। তার জেরে সম্প্রতি আফগানিস্তান সরকারের পক্ষ থেকে একটি কড়া চিঠি লেখা হয়েছে পাকিস্তানকে।
সেখানে বলা হয়েছে, ‘পাকিস্তানের সঙ্গে দীর্ঘস্থায়ী শান্তি এবং মৈত্রী গড়তে প্রেসিডেন্ট ঘানি যে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন তার কোনো প্রতিদান পাওয়া যাচ্ছে কিনা তা জানতে আফগানবাসী উৎসুক।’ পাশাপাশি ভারতের স্পর্শকাতরতা অগ্রাহ্য করে আইএসআই-এর সঙ্গে কাবুলের গোয়েন্দা সংস্থা যে সমঝোতাপত্র সই করেছিল সেটি পুনর্বিবেচনা করে দেখবেন বলে জানিয়েছেন খোদ ঘানিই। নয়াদিল্লির বক্তব্য ছিল, এই সমঝোতা আসলে ভারতবিরোধী গোয়েন্দা সমবায়েরই নামান্তর। নিজের সরকারের ভিতর থেকেই চাপে পড়ে সদ্য ঘানি জানিয়েছেন, দেশের মধ্যে সর্বসম্মতি না হওয়া পর্যন্ত তিনি আনুষ্ঠানিকভাবে ওই চুক্তি সই করবেন না। সব মিলিয়ে হিন্দুকুশ পর্বতের ওপার থেকে কোনো আশার আলো এখনো পর্যন্ত দেখতে পাচ্ছে না ভারত। সেখানকার ঘোলা জলে মাছ ধরতে নেমে পড়েছে বেইজিংও। চীনের জিনজিয়াং প্রদেশে সন্ত্রাসবাদ রোখার জন্য আফগানিস্তানের শান্তি প্রক্রিয়ায় নাক গলিয়েছেন সে দেশের সরকার। পাশাপাশি আফগানিস্তানে তাদের বিপুল অঙ্কের বিনিয়োগ যাতে সুরক্ষিত থাকে সেটা দেখাও বেইজিংয়ের অগ্রাধিকারের মধ্যে পড়েছে।