একটা সময় ছিল যখন মুরগির মাংস আমাদের কাছে লোভনীয় খাবার বলে মনে হতো। সে সময় পাঁঠা অথবা খাসির মাংসেরই চল ছিল। চা বাগানের বাড়িতে সপ্তাহে একদিন সেই মাংস রান্না হতো। পাতলা ঝোলের রঙ লাল, তাতে মাংসের টুকরোর সঙ্গে আলু, অত্যন্ত সুস্বাদু মনে হতো। রান্নাঘরে যখন ওই মাংস রান্না করা হতো তখন একশো গজ দূর থেকে তার বাস নাকে আসত। বন্ধুরা নাক টেনে বলত, 'তোদের বাড়িতে আজ মাংস রান্না হচ্ছে, নারে?' তখন বয়স দশ কী বারো। কিন্তু মুরগির মাংস আমাদের বাড়িতে রান্না হতো না।
সে সময় বন্যপ্রাণী শিকারের ওপর এখনকার বিধিনিষেধ জারি ছিল না। কেউ একজন হরিণ শিকার করে তার কিছুটা মাংস পাঠিয়ে দিয়েছিল। দেখলাম সেই মাংস তৈলাক্ত কলাপাতায় মুড়ে মাটির তলায় পুঁতে রাখা হলো ২৪ ঘণ্টা। তারপরে সেটাকে তুলে পাঁঠার মাংসের মতো রান্না করা হলো। আমার খেতে একটুও ভালো লাগেনি। বালি বালি লেগেছিল। তার চেয়ে বেশি মনে হয়েছিল হরিণটার মাংস খেয়ে অন্যায় করেছি। শকুনতলার অাঁচল ধরে পতিগৃহে যাওয়ার সময় টেনেছিল হরিণশিশু। হরিণ দেখলেই মনে মায়া আসে। তার মাংস খেয়ে একটুও খুশি হয়নি। পাশের বাড়ির খোকন আমাকে বুঝিয়েছিল ছাগলছানা আর হরিণশিশুর মধ্যে তেমন কোনো পার্থক্য নেই। ছাগলছানা যেভাবে লাফায়, আবদারের ভঙ্গিতে তাকায় তা অবিকল হরিণশিশুর মতো। তাই ছাগলের মাংস খেয়ে মনে যদি পাপবোধ না আসে হরিণের মাংসেও আসা উচিত নয়। এই যুক্তিতে মন ভোলেনি। তারপর থেকে আজ পর্যন্ত হরিণের মাংস সুযোগ পাওয়া সত্ত্বেও খাওয়া এড়িয়ে গেছি।
কিন্তু মুরগির মাংস যখন বাড়িতে রান্না হতো না, পরিচিত কারও বাড়িতে হতো কিনা জানা ছিল না তখন সেটা খাওয়ার জন্য আকর্ষণ বাড়ছিল। মুরগির বাচ্চাকে দেখলে ছাগল বা হরিণশিশুর মতো মনে মায়া আসে না। উল্টো যা নিষিদ্ধ, তার প্রতি আকর্ষণ সব সময় তীব্র হয়। কেন মুরগির মাংস খাব না, কেন বাড়িতে মুরগি রান্না হয় না, এই প্রশ্নের জবাবে মা-পিসিরা বলতেন, হিন্দুদের রান্নাঘরে মুরগি ঢোকে না। সেই বয়সের এক সহপাঠী যার নামের শেষে ভট্টাচার্য ছিল, জ্ঞানদান করেছিল, 'দ্যাখ, মুরগি খেলে আমাদের জাত চলে যাবে। তার কারণ, আমরা হলাম বোনাফাইড হিন্দু ব্রাহ্মণ, তোরা তো নীচের দিকের হিন্দু, গঙ্গাজলের সঙ্গে মুরগির মাংস খেলে তোদের জাত যাবে না।' শুনে খুব খারাপ লেগেছিল। তবু মাকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, 'আচ্ছা, তুমি গঙ্গাজলে মুরগির মাংস রাঁধতে পার না?' হেসে গড়িয়ে পড়ার অবস্থা মায়ের। বলেছিল, 'মুরগি কী খায় দেখেছিস? যত নর্দমার পচা জিনিস, পোকামাকড়।'
আমাদের ছেলেবেলাটা মুরগির মাংসশূন্য ছিল। তখন মুরগি বিক্রি হতো না কেটে। পাঁঠা-খাসির মাংস কেনা যেত আধসের কিন্তু মুরগি পালক সমেত। তার দামও ছিল পাঁঠা-খাসির চেয়ে অনেক সস্তা। হাটের দিন একেবারে নিরালায় গরুর মাংস বিক্রি হতো। মূলত সেই মাংসের ক্রেতা ছিলেন মুসলমান সম্প্রদায়ের মানুষ। এই বিভাজন আমরা সেই ছেলেবেলায় দেখে দেখে মেনে নিয়েছি। মুসলমানরা গরুর মাংস খান, হিন্দুরা খান না। মুরগি কিন্তু মুসলমান এবং খ্রিস্টানদের খেতে আপত্তি হতো না, শুধু তথাকথিত হিন্দুরাই বর্জন করতেন সেই সময়ে। শুধু মাংস নয়, মুরগির ডিমও বাড়িতে নিষিদ্ধ ছিল।
রামচন্দ্র যদি মুরগি খেতে পারেন, তাহলে পরবর্তীকালের হিন্দুরা তা বর্জন করল কেন? এ প্রসঙ্গে একটি ঘটনার কথা মনে পড়ল। শ্রদ্ধেয় বিভূতিভূষণ মুখোপাধ্যায় এবং শ্রদ্ধেয় মনোজ বসু মুম্বাইয়ের এক সাহিত্যসভায় আমন্ত্রিত হয়ে গিয়েছিলেন। রাতে তাদের খাওয়ার টেবিলে মুরগির মাংস পরিবেশিত হলো। বিভূতিভূষণ নিষ্ঠাবান ব্রাহ্মণ, বললেন, 'তিনি এবং তার পূর্বপুরুষ কখনোই মুরগির মাংস খাননি। তাই খেতে পারব না।' মনোজ বসু তখন তাকে রামচন্দ্রের মুরগি খাওয়ার গল্প শুনিয়ে রাজি করালে বিভূতিভূষণ খাওয়া শুরু করেন। অভ্যেসমতো খাবার গ্রহণ করার আগে তেরো পূর্বপুরুষের প্রতি উৎসর্গ করে খেয়েও নিলেন। খাওয়া শেষ হলে মনোজবাবু বলেছিলেন, 'বিভূতিদা, আপনি শুধু নিজেই মুরগি খেলেন না, আপনার পূর্বপুরুষদেরও খাওয়ালেন।' কোনো যুক্তিগ্রাহ্য কারণ আছে কিনা আমার জানা নেই। মুসলমানরা এদেশে আসার পর যে মানসিক বিরোধ শুরু হয়েছিল, মনে হয় হিন্দুরা সেই কারণে মুরগি বর্জন করেছিলেন। মুসলমানদের পোষা পাখি বলেই তাকে ঘরে ঢুকতে দেননি। কিন্তু এই বিভাজন শেষ পর্যন্ত টিকল না।
আমি প্রথম মুরগির মাংস খেয়েছি চালসার পিডব্লিউডি বাংলোতে। শীতের সেই রাতে বাবুর্চির অনবদ্য রান্না খেয়েছিলাম কয়েকজন মিলে। তখন আমাদের তরুণ বয়স। নিষিদ্ধ খাদ্য খাওয়ার উন্মাদনা তো ছিলই কিন্তু সেই বয়স্ক মানুষটির হাতের রান্না আজও ভুলতে পারিনি। তারপর একটা সময় এলো যখন কেউ নেমন্তন্ন করে মুরগির মাংস খাওয়াচ্ছে শুনলে খুশি হতাম। ধীরে ধীরে মুরগি বাঙালির হেঁশেলে ঢুকে গেল এবং শেষ পর্যন্ত তা খাসির মাংসকে পিছনে সরিয়ে দিল। এর বড় কারণ হলো, স্বাস্থ্যরক্ষা। ডাক্তাররা বললেন, পাঁঠা-খাসি হলো রেডমিট। যা খেলে স্বাস্থ্যহানি হবেই। তার চেয়ে মুরগি খান। সঙ্গে সঙ্গে 'জয় রামচন্দ্র' না বলেও বাঙালি মুরগি আর তার ডিমকে অাঁকড়ে ধরল। আমাদের তরুণ বয়সে মুরগি একই রকমের ছিল। ক্রমশ সে দ্বিধাবিভক্ত হলো। দেশি এবং ব্রয়লার। এখন মুরগির মাংসে আর রুচি নেই। ব্রয়লারের তো নয়ই। সাদা ছিবড়েতে আগ্রহ চলে গেছে। চালসার বাংলোর মুরগির স্মৃতি বেঁচে থাক, আমি এখন মুরগিবিমুখ। তার চেয়ে, কে আগে, মুরগি না তার ডিম, এ নিয়ে আড্ডা মারতে খারাপ লাগে না।
লেখক : কথাসাহিত্যিক।