ভারতীয় সংসদে সীমান্ত চুক্তি বাস্তবায়ন বিল পাস হলো, নরেন্দ্র মোদির সফরের সময় দুই দেশের প্রধানমন্ত্রী এ-সংক্রান্ত দলিলাদির হস্তান্তর প্রক্রিয়াও সম্পন্ন হলো। সবই দারুণ ইতিবাচক; কিন্তু ছিটমহল বিনিময়ের ক্ষেত্রে ভারতের দিক থেকে পুনর্বাসনের জন্য ৩ হাজার কোটি রুপি বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে; আর আমাদের এবারের বাজেটে ছিটমহলের উন্নয়নে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে মাত্র ২০০ কোটি টাকা! অথচ বাংলাদেশের প্রাপ্ত ১১১টি ছিটমহলে মোট জমির পরিমাণ ১৭ হাজার ১৫৮ একর আর ভারতের প্রাপ্ত ছিটমহলের সংখ্যা ৫১টি, জমির পরিমাণ ৭ হাজার ১১০ একর। প্রিয় পাঠক, আপনারাই বিবেচনা করুন, ১৭ হাজার একর জায়গাজুড়ে পুনর্বাসন ও উন্নয়নের জন্য বাংলাদেশ সরকার বরাদ্দ দিয়েছে ২০০ কোটি টাকা আর ভারতের ক্ষেত্রে তাদের সরকার ৭ হাজার একর ভূমির উন্নয়ন ও পুনর্বাসনে বরাদ্দ দিয়েছে ৩ হাজার কোটি রুপি। আর কে না জানে উন্নয়ন তো ভূমি বা জমির হয় না, হয় মানুষের। তাহলে দেখে নেওয়া যাক, মানুষের হিসাবটি কেমন? বাংলাদেশের প্রাপ্ত ১১১টি ছিটমহলে সবশেষ শুমারি অনুযায়ী জনসংখ্যা ৩৭ হাজার ৩৬৯; অন্যদিকে ভারতের প্রাপ্ত ৫১টি ছিটমহলের জনসংখ্যা ১৪ হাজার ২১৫; অর্থাৎ জমি ও মানুষ দুই হিসাবেই আমাদের অংশ বৃহত্তর। জমি প্রাপ্তি ভারতের তুলনায় দ্বিগুণেরও বেশি আর মানুষের হিসাবে তা প্রায় তিনগুণ। অথচ বাজেট বরাদ্দ ভারতের চেয়ে ২৫ গুণ কম; জমি-মানুষের অনুপাতে হিসাব করলে তা প্রায় ৫০ গুণ কম। অথচ ছিটমহলবাসীর মৌলিক অধিকার ফিরিয়ে দেওয়াই এখন আমাদের বড় চ্যালেঞ্জ। দরকার দ্রুততম সময়ে ছিটমহলবাসীর নিজ পরিচয়ে পাসপোর্ট তৈরি, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ তাদের মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করা। সেখানে এতদিন জমি কেনাবেচা হয়েছে সাদা কাগজে। একে আইনের আওতায় আনতে হবে। এটা দ্রুত করতে হবে, না হলে সেখানে সংঘর্ষ-হাঙ্গামা শুরু হয়ে যাবে। বিগত ৬৮ বছর ধরে ছিটমহলের তিনটি প্রজন্ম নাগরিক অধিকার পায়নি। তাদের সামাজিক নিরাপত্তাও নেই। বিপর্যস্ত স্বাস্থ্যসেবা। আছে বাণিজ্য বৈষম্যও। যদিও ছিটমহলের মানুষ মূলত কৃষি কাজ করেই জীবিকা নির্বাহ করেন। তবে সেখানে এখন কী ধরনের কর্মসংস্থান করা যেতে পারে, সে বিষয়টি নিয়ে এখনই সরকার ও অংশীজনদের উদ্যোগ নেওয়া দরকার।
কেউ-ই অস্বীকার করছে না, সম্প্রতি ভারতীয় লোকসভায় ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে সীমান্ত চুক্তি বাস্তবায়ন বিল পাস হওয়ার বিষয়টি রীতিমতো ঐতিহাসিক। এ কেবল চুক্তি বাস্তবায়ন নয়, ৬৮ বছর ধরে হাজারো মানুষের যে পরিচয়ের সংকট চলছিল- এ তার রাজনৈতিক সমাধান। ঠিকানাহীনদের কাঙ্ক্ষিত ঠিকানা। এই সাফল্য একই সঙ্গে আত্দোপলব্ধি ও গর্বেরও বটে। বঙ্গবন্ধু ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে শুধু চুক্তি করেননি, ৪১ বছর আগে তিনি বাংলাদেশের সংসদে এই সীমান্ত চুক্তি পাসও করিয়েছিলেন। ছিটমহলের ৫৫ হাজার মানুষ ৬৮ বছর ধরে অমানবিক জীবনযাপন করেছেন। বিল পাস হওয়ার পর ছিটমহলগুলো ঘিরে তৈরি হয়েছে নানা প্রত্যাশা। তবে যা কিছু করার মর্যাদা রক্ষা করেই করতে হবে। হৃদয়ে বাংলাদেশকে লালন করতে হবে। ভারতের পার্লামেন্টে যেভাবে সর্বসম্মতিক্রমে সীমান্ত বিল পাস হয়েছে, তা বাংলাদেশের রাজনীতির জন্য দৃষ্টান্ত হতে পারে। কীভাবে প্রতিবেশীর সঙ্গে সম্পর্ক রক্ষা করতে হয় এবং জাতীয় বিষয়ে একমত হতে হয় তা ভারতের এ ঘটনা থেকে শিখতে পারেন বাংলাদেশের রাজনীতিকরা। রাজনীতিতে দুই বিপরীত মেরুতে অবস্থান করলেও নরেন্দ্র মোদি ও সোনিয়া গান্ধী যেভাবে একসঙ্গে জাতীয় স্বার্থে কাজ করলেন, আমরা আশা রাখতে চাই, বাংলাদেশের রাজনীতিকরা সেভাবে এগিয়ে আসবেন। ঐকমত্যের ভিত্তিতে মর্যাদা ধরে রেখে বিদ্যমান সংকটগুলোর সমাধানই হোক বাংলাদেশের লক্ষ্য। বাংলাদেশের হয়ে যারা এ বিল পাসের জন্য কাজ করেছেন বিশেষ করে সরকার, সরকারপ্রধান ও গণমাধ্যম এক্ষেত্রে ধন্যবাদ পাওয়ার যোগ্য। ভারত তাদের সংবিধান সংশোধন করে দীর্ঘমেয়াদি এই সমস্যার সমাধানে উদ্যোগী হয়েছে। এর মধ্য দিয়ে মানবিক সমস্যার সমাধান হয়েছে। ছিটমহলের মানুষ ভৌগোলিক বাসিন্দা হয়েও নাগরিক সেবা পাননি আইনি সীমাবদ্ধতার কারণে। এত দিন এটা ভারতবিরোধী কার্ড হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। এর মধ্য দিয়ে ভারত তার ঐতিহাসিক দায় মিটিয়েছে।
ভাবা যায়, কংগ্রেস সরকারের প্রটোকল মোদি সরকার বাস্তবায়ন করেছে। এটা এক বিরল ঘটনা। এটি দুই দেশের প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক দূরদর্শিতার বহিঃপ্রকাশ। সীমান্ত চুক্তি আগে আসামকে বাদ দিয়ে করার চিন্তাভাবনা করা হয়েছিল। এবার সবাইকে নিয়েই চুক্তি করা হয়েছে। আমাদের বিরোধী দল বিএনপিও ভারত সরকারকে অভিনন্দন জানিয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকে অভিনন্দন জানায়নি। এটাও ঠিক নয়। আমাদের রাজনৈতিক অঙ্গনের সংস্কৃতিই হচ্ছে স্বীকার না করার প্রবণতা। এ কারণেই জাতি হিসেবে আমরা এগিয়ে যেতে পারছি না। দুই দেশের মধ্যে জমি বা ছিটমহল বিনিময়ের ক্ষেত্রে সার্বভৌমত্ব বিনিময়ের প্রয়োজন হয়েছে। এ কারণেই উভয় দেশের সংবিধানে পরিবর্তন করতে হয়েছে। ভারত তাদের সংবিধানের ১০০তম সংশোধনীর মাধ্যমে এর সমাধান করল। জমি প্রদানের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক ও মনস্তাত্তি্বক বাধা কাজ করেছে। সংসদে কেউ গান গেয়ে, কেউ স্মৃতিচারণ করে নিজেদের মনোভাব প্রকাশ করেছেন। এর মাধ্যমে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের মধ্যে পারস্পরিক খোঁচা লাগার সবচেয়ে বড় বিষয় সীমান্ত চুক্তির সমাধান হলো। এটি একটি সমন্বিত চুক্তি। কারণ এর মাধ্যমে একসঙ্গে ছিটমহল, অপদখলীয় জমি, অচিহ্নিত সীমারেখাসহ সীমান্তের সব সমস্যার সমাধান সম্ভব। কোনো পক্ষের জন্য ক্ষতিপূরণের বিধান নেই এবং কোনো ধরনের আস্থার সংকটও তৈরি হয়নি। দুই দেশের নেতৃত্বেরই বড় কূটনৈতিক সাফল্য। দুই দেশের নিরাপত্তা নিশ্চিতের জন্য সীমান্ত চুক্তি যেমন জরুরি বিষয়, তেমনি আঞ্চলিক নিরাপত্তা নিশ্চিতেও এর ভূমিকা হবে অবিস্মরণীয়। এটি বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ ও দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক রাজনীতিতেও ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে। এটা বাংলাদেশের জন্য বড় অর্জন। এ চুক্তি বাস্তবায়নের ফলে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি আরও বেড়ে গেছে। এতে ভারতও দায়মুক্তি হয়েছে। বিদ্যুৎসহ নানা খাতে সহযোগিতা চলছে- এগুলোর দিকেও মনোযোগ দিতে হবে।
৪১ বছর পরে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সরকারের সময়, ১৯৭৪ সালের মুজিব-ইন্দিরা চুক্তির বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে- এ প্রজন্মের একজন হিসেবে এটা দেখার অভিজ্ঞতা নিঃসন্দেহে বিস্ময়কর! এর মধ্য দিয়ে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের জল ও স্থল দুই ধরনের সীমান্তই চিহ্নিত হয়ে গেল। আমাদের দেখার দৃষ্টিভঙ্গিও পাল্টাতে হবে। ভারতের রাজনীতিতে যেভাবে সর্বদলীয় উদ্যোগে সীমান্ত চুক্তি পাস হয়েছে, সেটি একটি অনুকরণীয় বিষয়। এক্ষেত্রে ভারতের নেতৃত্বের দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশিত হয়েছে। নরেন্দ্র মোদি একজন বাস্তববাদী নেতা। তার এ নেতৃত্বেই দীর্ঘদিন ধরে ঝুলে থাকা সীমান্ত সমস্যার সমাধান সম্ভব হয়েছে। তাই মোদির প্রধানমন্ত্রিত্বের সুযোগে প্রতিবেশী বাংলাদেশ-ভারতের সমস্যা সমাধানের সুযোগ গ্রহণ করতে হবে। ভারতের কূটনীতি বিশ্বের অন্যতম সেরা কূটনীতি। এখনই সময় বাংলাদেশের দ্বিপক্ষীয় সব দাবির কথা উত্থাপন করার। আঞ্চলিক জোট বিমসটেক গঠনের সময় বাংলাদেশকে বাদ দিয়ে করা হচ্ছিল; কিন্তু প্রতিষ্ঠাতা সদস্য হতে অনড় থাকে বাংলাদেশ। সে কারণে বাংলাদেশকে নিয়েই তা গঠিত হয়। এখন বাংলাদেশের গভীর সমুদ্রবন্দরে চীনের সহায়তা নিয়ে ভারত উদ্বিগ্ন। এ উদ্বিগ্নতা দূর করতে আলোচনা করতে হবে। তাহলে আমাদের একটি গভীর সমুদ্রবন্দরও থাকবে। সীমান্ত চুক্তি পাসের পর যে সুযোগটা এসেছে আমাদের উচিত তাকে কাজে লাগানো। বর্ডার কিলিং, অন-অ্যারাইভাল ভিসা, তিস্তা চুক্তিসহ অন্য বিষয়গুলোকে এখন আলোচনার মাধ্যমে এগিয়ে নিতে হবে। ফোকাস যদি অর্থনৈতিক উন্নয়নের দিকে যায় তাহলে অনেক কিছুই সম্ভব হবে।
আরও এগিয়ে যাওয়ার জন্য যা দরকার তাহলো দুই দেশের রাজনৈতিক নেতৃত্বের সদিচ্ছা ও প্রজ্ঞার। দরকার ধর্মভিত্তিক কূটনীতিকে বাদ দিয়ে সামনে এগোনো। অতীতে এই ধর্মভিত্তিক কূটনীতি আমাদের পিছিয়েছে। আমাদের দেখিয়ে দিয়েছে আন্তর্জাতিক চুক্তির ক্ষেত্রে জাতীয় স্বার্থ কীভাবে বুঝে নিতে হয়। বাংলাদেশ এক্ষেত্রে লাভবান হয়েছে। আমাদের জাতীয় সক্ষমতা আরও বাড়াতে হবে। তৈরি করতে হবে ভারতনীতি। যেমন- ভারত বাংলাদেশ বিষয়ে নীতি তৈরি করেছে। এ নিয়ে বিস্তর গবেষণা করতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে 'ভারত স্টাডিজ' নামে স্বতন্ত্র বিষয় যুক্ত করতে হবে যে রকমটি ভারতে আছে 'বাংলাদেশ স্টাডিজ'। আসলে বিগ ব্রাদার বলে কিছু নেই, থাকা উচিত নয়। আমরা সবাই সামর্থ্যবান। বাংলাদেশকে এখন ভারত, চীন ও জাপান সবাই সহযোগিতা দেয়। মনে রাখা দরকার কেবল রাজনৈতিক সম্পর্ক টিকে থাকে না, দরকার শক্তিশালী অর্থনৈতিক সম্পর্ক। জয়-পরাজয়ের বিষয় নয়, স্বাধীন-সার্বভৌম দেশ হিসেবে আরও সম্প্রীতির বন্ধনের মাধ্যমে আমাদের ন্যায্য দাবিগুলো অন্য রাষ্ট্রের থেকে আদায় করতে হবে।
লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়; [email protected]