ইদান প্রাইজ ফাউন্ডেশনের সহায়তায় ব্র্যাক বর্তমানে বাংলাদেশ, উগান্ডা ও তানজানিয়ায় বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। বাংলাদেশে আমরা শিশুর পরিচর্যা বিষয়ে এবং প্রাকশৈশব বিকাশের জন্য একটি টেলিযোগাযোগ মডেল পরীক্ষামূলকভাবে বাস্তবায়ন করছি। এছাড়া, উগান্ডা ও তানজানিয়ার সরকারি স্কুলগুলোয় প্লেল্যাব মডেলের ওপরও জোর দিচ্ছে। এসব কার্যক্রম নিয়ে আমরা খুব উৎসাহী, কেননা এর মধ্য দিয়ে শিশুদের জন্য আরো বেশি খেলার সুযোগ এবং আরো বেশি বাবা-মা ও জনগোষ্ঠীর জন্য খেলার উপকারিতা বোঝার জন্য সুযোগ তৈরি করে দিচ্ছে। তাছাড়া, এর মধ্য দিয়ে খেলাকে কেন্দ্র করে গড়ে তোলা মডেলগুলোকে আরও উন্নত করার জন্য প্রয়োজনীয় বিষয়গুলো শেখার সুযোগ তৈরি হচ্ছে আমাদের।
করোনা অতিমারীর সময় আমাদের একদিকে নতুন পরিস্থিতির সঙ্গে মানিয়ে চলতে হয়েছে, অন্যদিকে হতে হয়েছে আরো সৃজনশীল। প্লেল্যাব দিবাযত্ন কেন্দ্র উদ্যোক্তা মডেলটি তৈরি পোশাক শিল্পে কর্মরত শ্রমিকদের জন্য কী ধরনের সুযোগ তৈরি করতে পারে তা খতিয়ে দেখছি আমরা। তৈরি পোশাকের কারখানা রয়েছে এমন এলাকাগুলোতে আমরা এই মডেলটির পরীক্ষামূলক বাস্তবায়ন করছি যার মধ্যে দিয়ে বুঝতে চেষ্টা করছি বাড়িভিত্তিক দিবাযত্নকেন্দ্র মডেল কাজে লাগিয়ে মহিলা উদ্যোক্তারা শিশু পরিচর্যার চাহিদা কীভাবে পূরণ করতে পারেন। এ বিষয়ে মোবাইল ফোনের মাধ্যমে উদ্যোক্তাদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। আমরা লক্ষ করেছি মডেলটি সম্পর্কে শিখতে ও একে এগিয়ে নিতে তাঁরা খুবই আগ্রহী।
শিশুরা খেলতে খেলতে শেখার ব্যাপারে খুবই আগ্রহী এবং এতে তাদের দ্রুত মানসিকভাবে সম্পৃক্ত করা সম্ভব হয়। লকডাউনের সময় ছেদ পড়লেও মডেলটি তাদের মনোযোগ দ্রুত ফিরিয়ে আনতে সাহায্য করে।
প্লেল্যাব, হিউম্যানিটেরিয়ান প্লেল্যাব ও টেলিকমিউনিকেশন মডেল তিনটির ক্ষেত্রেই আমরা শিশুর পাশাপাশি শিশুর পরিচর্যাকারীর ওপরও মনোযোগ দিয়ে থাকি। শৈশবের বিকাশে পরিচর্যাকারী গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। সুতরাং আমরা চেষ্টা করি যাতে তারা একাধিক পদ্ধতি বা কৌশল অবলম্বন করে শিশুকে খেলায় সম্পৃক্ত হতে সহায়তা করতে পারেন। শিশু পরিচর্যাকারীর সার্বিক কল্যাণের দিকেও আমরা জোর দিয়ে থাকি কারণ তাদের অবস্থা শিশুর ওপর গভীর প্রভাব ফেলে।
“পাশে আছি” একটা স্বল্প-প্রযুক্তির মডেল, যার মাধ্যমে শেখার প্রক্রিয়ার সঙ্গে মনোসামাজিক সহায়তা সম্পৃক্ত করা সম্ভব হয়েছে। মডেলটির মূল ভাবনা হচ্ছে, সম্মুখসারির একজন কর্মী প্রতি সপ্তাহে একবার পরিচর্যাকারীদের সঙ্গে কুড়ি মিনিট ফোনে কথা বলবেন। এই সময় তিনি শিশুর সঙ্গেও কথা বলবেন। এর ফলে অতিমারীর সময় সামাজিক দূরত্ব মেনে চলার বাধ্যবাধকতা ও লকডাউনের মধ্যেও ১১০৬ জন প্রশিক্ষিত সম্মুখসারির কর্মী ৩৭ হাজার পরিচর্যাকারী, তাঁদের সন্তান ও পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগের মধ্যে থাকতে পেরেছেন এবং তাঁদের পরামর্শ সহযোগিতা দিতে সক্ষম হয়েছেন। “পাশে আছি” মডেলটি দূরশিক্ষণের মাধ্যমে শিশুদের খেলা ও বিভিন্ন কার্যক্রমে যুক্ত করার মধ্য দিয়ে শিখতে সাহায্য করে। পাশাপাশি মনোসামাজিক সেবাও দিয়ে থাকে। অতিমারীর সময় পরিচর্যাকারী ও শিশু উভয়ের সঙ্গেই যুক্ত থাকা জরুরি বলে মনে করেছি আমরা। এই মডেলটি আমাদের যুক্ত থাকার সেই উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে সহায়ক হয়েছে। এক্ষেত্রে দূর থেকে বাস্তবায়নযোগ্য কোনো প্রক্রিয়া ছাড়া অন্য কোনো প্রক্রিয়া গ্রহণ সম্ভব ছিল না। “পাশে আছি” মডেলটি সহজে ও ব্যয়সাশ্রয়ীভাবে সেই কাজটি করতে সহায়তা করেছে আমাদের। পরীক্ষামূলক প্রয়োগের সময় এ বিষয়ে অনেককিছু শিখেছি আমরা। এখন আমরা মডেলটির প্রসারে কাজ করব বলে ভাবছি।
প্লেল্যাব দিবাযত্ন কেন্দ্র মডেলটি তৈরি করা হয়েছে তৈরি পোশাক শিল্পে নিয়োজিত শ্রমিকদের প্রয়োজনের কথা মাথায় রেখে, যাতে কাজে ব্যস্ত বাবা-মায়ের সন্তানদের খেলার মাধ্যমে শেখার সুযোগ করে দেওয়া যায়। অন্যদিকে “পাশে আছি” একটি দূরশিক্ষণ মডেল, যা দিয়ে শেখার ধারাবাহিক প্রক্রিয়াটি কোনো কারণে বাধাগ্রস্ত হলে তা পাশ কাটিয়ে শিশুর শেখার ধারাটিকে চলমান রাখা যায়। মডেলটিকে সহজেই একটি ব্যয়সাশ্রয়ী “প্যারেন্টিং” মডেলে রূপ দেওয়া সম্ভব যার সাহায্যে দুর্গম অঞ্চলের শিশুদের সেবা দেওয়া সম্ভব হবে, বিশেষ করে যেসব এলাকায় সশরীরে উপস্থিত থেকে প্রাকশৈশব বিকাশের সেবা দেওয়া অনেকটাই কঠিন।
কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যায়নি এমন শিশুদের শিক্ষা প্রদানে ব্র্যাকের বড় ধরনের অভিজ্ঞতা রয়েছে। এ পর্যন্ত এক কোটি ৪০ লাখের বেশি শিশু ব্র্যাকের বিদ্যালয়গুলো থেকে পাশ করেছে। বর্তমানে ব্র্যাকের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে সাত লাখ ৫০ হাজার শিশু পড়াশোনা করছে। চলমান অতিমারীর সময়ও বাড়িতে বসে ব্র্যাকের শিক্ষা কার্যক্রম চালু আছে। স্মার্টফোন, কমিউনিটি রেডিও এবং টেলিভিশন ব্যবহার করে ব্র্যাক স্কুলের শিক্ষার্থীদের নিয়মিত পাঠদান চালু আছে।
আমাদের শিশুশিক্ষা কার্যক্রমের ভিত্তি আনন্দের মাধ্যমে শিক্ষা। শিশুরা যাতে স্কুলে আসতে আগ্রহী হয় সেজন্য আমরা নিয়মিত পাঠক্রমের বাইরে নানা ধরনের কার্যক্রম, হাতে-কলমে কাজ ও দলগত কাজ পরিচালনা করি। ব্র্যাকের উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা মডেলটি এক্ষেত্রে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য। মডেলটি সরকারের স্বীকৃতি ও আর্থিক সহায়তা পেয়েছে। এটি দ্বিতীয় সুযোগ মডেল নামেও পরিচিত। আমাদের অন্যান্য শিক্ষা উদ্যোগের মধ্যে ব্র্যাক একাডেমি রয়েছে যেখানে নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তানরা উচ্চমানের শিক্ষার সুযোগ পেয়ে থাকে। এছাড়া আমরা ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর শিশুদের মাতৃভাষায় শেখার সুযোগ সৃষ্টির জন্য “মাল্টিলিঙ্গুয়াল এডুকেশন” মডেল তৈরি করেছি। নগরের নিম্নআয়ের বসতি এলাকায় একাধিক “নিউরোডেভেলাপমেন্টাল ডিজেবিলিটি সেন্টার”ও স্থাপন করেছে ব্র্যাক, যা দরিদ্র পরিবারভুক্ত নিউরোডেভেলাপমেন্টজনিত সমস্যায় আক্রান্ত শিশুদের শিক্ষার সুযোগ প্রদানে কাজ করছে।
প্রাকশৈশব বিকাশ ও শিশুশিক্ষায় ব্র্যাকের বেশ বড় পরিকল্পনা রয়েছে। প্রাকশৈশব বিকাশ ব্র্যাকের জন্য তুলনামূলক নতুন একটি এলাকা। এতে আমরা কারিগরি শিক্ষা ও অভিজ্ঞতা অর্জন করেছি এতদিন। বর্তমানে এসব অভিজ্ঞতার বৃহত্তর বাস্তবায়নের দিকে যাব আমরা। খেলাকেন্দ্রিক প্রাকশৈশব বিকাশ ও মানসিক স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে আমরা যে দৃষ্টিভঙ্গি ও কৌশল নিয়ে কাজ করছি তা অনন্য বলেই মনে করি আমরা। নতুন কর্মসূচি হাতে নেওয়ার মাধ্যমে আমাদের কৌশল ও অভিজ্ঞতা কাজে লাগানোর চেষ্টা করছি। একইসঙ্গে এক্ষেত্রে নতুন নতুন উদ্ভাবন ও তথ্যভিত্তিক জ্ঞান অর্জনও চলতে থাকবে। এই মুহূর্তে আমরা একটি বৈশ্বিক প্রাকশৈশব বিকাশ কৌশল চূড়ান্ত করার কাজ করছি। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বিপুলসংখ্যক শিশুকে প্রত্যক্ষ সেবা প্রদান এবং সরকারের সঙ্গে যৌথ বাস্তবায়নের মাধ্যমে কাজ করার ক্ষেত্রে সহায়ক হবে এই কৌশল।
শিশুদের প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিত করা এবং অতিমারীর সময় ঝরে পড়া শিশুদের বিদ্যালয়ে ফিরিয়ে আনাই হবে ব্র্যাকের অগ্রাধিকার। শেখার ক্ষেত্রে ইতিমধ্যে যে বিপুল ক্ষতি হয়েছে এবং এই সময়টায় শিশুদের যে মানসিক চাপের মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে, তা পুষিয়ে নেওয়ার দিকে বিশেষ জোর দেওয়া হবে। এজন্য শিশুদের নিয়ে গঠিত “লার্নিং গ্রুপস” ও বিষয়ভিত্তিক শেখার কৌশল কাজে লাগানো হবে।
লেখক: ব্র্যাকের নির্বাহী পরিচালক