আমাদের চারপাশে অসংখ্য মানুষ রয়েছেন যারা নিবেদিতভাবে, নিভৃতে দেশ ও মানুষের কল্যাণে কাজ করে যান। ভালোবেসে তাঁরা যেমন অন্যের প্রয়োজনে কাজ করেন, তেমনি চেষ্টা করেন নিজের কাজের মাধ্যমে উন্নত সমাজ নির্মাণে অবদান রাখতে। গত বছর দেশে করোনা মহামারি আঘাত হানার পর থেকে আমরা যে ঘরে বসে নিশ্চিন্তে অফিসের সকল কাজ চালিয়ে যেতে পারছি, অনলাইনে শিক্ষার্থীরা তাদের পড়াশোনা চালিয়ে যেতে পারছে, ব্যবসা-বাণিজ্য অনলাইনে তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারছে, এসবের পেছনে রয়েছে দ্রুতগতির ইন্টারনেট আর দেশজুড়ে বিস্তৃত নেটওয়ার্ক রক্ষণাবেক্ষণে অবিরাম কাজ করা এক দল মানুষ।
করোনা মহামারির প্রাদুর্ভাব মোকাবিলায় গত বছর থেকেই থেমে থেমে লকডাউন চলছে দেশজুড়ে। এমন প্রেক্ষিতে, কল-কারখানা থেকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, সবকিছুই চলছে কানেক্টিভিটির ওপর নির্ভর করে। তাই, মানুষের নেটওয়ার্কের ওপর নির্ভরতা ও ইন্টারনেটের ব্যবহার বেড়ে গেছে বহুগুণ। ইন্টারনেটের দ্রুতগতির পাশাপাশি প্রয়োজন হয়েছে নিরবচ্ছিন্ন সেবা। এই প্রেক্ষিতে, অনলাইনে সকল কার্যক্রম চলমান রাখতে নেটওয়ার্ক সেবাকে জরুরি সেবা হিসেবে ঘোষণা করে সরকার। তাই, সব যখন বন্ধ তখনও জরুরি সেবায় নিয়োজিত ব্যক্তিদের নিজের প্রাণ বাজি রেখে পেশাগত দায়িত্ব পালনে কাজ করতে হয়েছে। বৈশ্বিক মহামারির ভেতর তাঁদের কখনো কাজ করতে হয়েছে করোনা ঝুঁকিপূর্ণ ইট-পাথরের শহরে, কখনো ছুটতে হয়েছে দেশের দুর্গম অঞ্চলে। এমনই দু’জন নিবেদিত নেটওয়ার্ক ইঞ্জিনিয়ার সায়াদাত আরেফিন খান ও সাদ্দাম হোসেন। গ্রাহকদের নেটওয়ার্ক সেবা প্রদানে করোনার এই সময় বিভিন্ন বাধা-বিপত্তি পেরিয়ে নিজের দায়িত্বকে অগ্রাধিকার দিয়েছেন তাঁরা।
(১)
সময়টা ২০২০ সালের ২১ এপ্রিল। দেশজুড়ে চলছে লকডাউন। তথ্য ও প্রযুক্তি অবকাঠামোগত সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান হুয়াওয়ে’তে কাজ করেন সায়াদাত আরেফিন খান। সেদিন দুপুরে সায়াদাত অফিসে ব্যস্ত দিন পার করছিলেন। রাতে নেটওয়ার্ক সম্প্রসারণের বেশ বড় একটি কাজ করতে হবে তাঁকে। সেই সময় সাধারণ মানুষের সকল কাজ, তথা দেশের অর্থনীতি সচল রাখতে যখন কানেক্টিভিটি সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখছে, তখন নেটওয়ার্ক রক্ষণাবেক্ষণ, আপগ্রেডেশন ও সম্প্রসারণের কাজ সময়মতো না হলে সকল প্রকার ডিজিটাল যোগাযোগে ব্যাঘাত ঘটবে। এই প্রতিকূল সময়ে বেশ কঠিন সমস্যার সম্মুখীন হতে হবে সবাইকে। তাই, জনসাধারণের প্রয়োজনীয়তা অনুযায়ী সেই রাতেই জরুরি ভিত্তিতে তাকে করতে হবে নেটওয়ার্ক সম্প্রসারণের কাজ। প্রকল্প রাজধানীর গুলশানে অবস্থিত উদয় টাওয়ারে। সাথে থাকবেন আরেকজন সহকর্মী।
জরুরি কাজ, বিধায় গ্রাহকের প্রয়োজনীয়তা পূরণে লকডাউনের ভেতরেই কাজের সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন করা হয়েছে খুব দ্রুত। কিন্তু কাজ বাকী আছে আরও কিছু। এরই মধ্যে সময় যখন দুপুর; ফোন আসলো বাসা থেকে। সন্তানসম্ভবা স্ত্রীর প্রসব বেদনা উঠেছে, জরুরি ভিত্তিতে তাকে হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে। ফোন পেয়ে সহকর্মীকে জানিয়ে তৎক্ষণাৎ ছুটে গেলেন স্ত্রীর কাছে। করোনা মহামারির দুঃসময়ে স্ত্রীকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করলেন। সেদিন সন্ধ্যায় ঢাকার সেই হাসপাতালে জন্ম নিল সায়াদাতের ফুটফুটে এক পুত্র সন্তান। মা ও শিশু দু’জনেই সুস্থ। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন সায়াদাত।
লকডাউনের কারণে ফাঁকা হাসপাতাল। করোনা মহামারির জন্য ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী হাসপাতালে সর্বোচ্চ একজন রোগীর সাথে অবস্থান করতে পারবেন। একদিকে পরিবার, অপরদিকে জরুরি কাজ। নেটওয়ার্কের কাজ ঠিকমত শেষ করতে কমপক্ষে দু’জন প্রয়োজন। কিছুক্ষণ আগে সন্তান জন্ম দেয়া স্নেহময়ী স্ত্রী আর শত আকাঙ্ক্ষিত সদ্যজাত সন্তানকে হাসপাতালে একা রেখে যেতেও মন সায় দিচ্ছে না। দ্বিধায় পড়ে গেলেন সায়াদাত। সায়াদাতের স্ত্রীর বোন হাসপাতালে থাকতে রাজি হওয়ায় আশ্বস্ত হয়ে কঠোর পরিশ্রমী সায়াদাত কাজ সম্পন্ন করতে ছুটে গেলেন গুলশানে। সারা রাত কাজ করলেন গ্রাহকের জন্য সর্বোচ্চ সেবা নিশ্চিত করতে। নির্ঘুম রাতের পর সকালে কাজ শেষে এক মুহূর্ত দেরি না করে আবার ফিরে গেলেন স্ত্রীর কাছে।
সমাজের প্রতি দায়িত্ব পালনের পর, পিতার দায়িত্ব পালনে অফিস থেকে পিতৃত্বকালীন ছুটি উপভোগ করেন সায়াদাত। স্বামীর কর্তব্যনিষ্ঠা এবং এই কঠিন সময়ে মানুষের প্রয়োজনে তাঁর কাজ করার প্রচেষ্টা দেখে গর্বিত তাঁর পরিবার। বাবার দায়িত্ববোধের চেতনা থেকে শিক্ষা নিয়ে সন্তানও একদিন এমন সমাজের প্রতি দায়িত্বশীল মানুষ হিসেবে গড়ে উঠবে এমনটাই প্রত্যাশা তাঁর স্ত্রীর।
(২)
এবার গুলশানের পরিপাটি নগর থেকে চলে যাই বনাঞ্চলে। বিশ্বের সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবনের দক্ষিণ পূর্বকোণে অবস্থিত বৈচিত্র্যময় একটি স্থান কটকা। মংলাবন্দর থেকে প্রায় ৯০ কি.মি. দূরে অবস্থিত এই স্থানটি সুন্দরবন পূর্ব অভয়ারণ্যের প্রধান কেন্দ্র। সুন্দরবনের প্রাকৃতিক দৃশ্য উপভোগের জন্য এখানে রয়েছে একটি ৪০ ফুট দীর্ঘ ওয়াচ টাওয়ার, আর আছে বন বিভাগের একটি রেস্ট হাউস। বন বিভাগের কিছু মানুষ ছাড়া এখানে মানব বসতি নেই বললেই চলে। সামনে সাগরের বিশাল জলরাশি আর চারপাশে অসংখ্য ছোট-বড় খাল। খালের ধারে মেলে চিত্রল হরিণ, সাপ, বানর, শূকর, উদবিড়াল, বন মোরগ সহ বিভিন্ন বণ্য প্রাণীর দেখা। মাঝে মাঝে বাঘের গর্জনও শোনা যায়। আর শীতের সময় দেখা মিলতে পারে রোদ পোহানো লোনা জলের কুমিরের। জীববৈচিত্রের সাথে সাথে এখানে জীবন সংশয়ের সম্ভাবনাও কম না। বন্য প্রাণীর সাথে আছে জলদস্যুর ভয়।
করোনা মহামারি চলাকালীন গত শীতে কাজের তাগিদে বরিশালে ছিলেন হুয়াওয়ের মাইক্রোওয়েভ ইঞ্জিনিয়ার মো. সাদ্দাম হোসেন। সেখান থেকে নেটওয়ার্ক সংক্রান্ত কাজে তাকে জরুরি ভিত্তিতে যেতে হয় সুন্দরবনের কটকায়। কটকায় এক সময় টুজি নেটওয়ার্ক থাকলেও পরে তা থ্রিজি এবং ৪জি-তে রূপান্তরিত করা হয়, কিন্তু নেটওয়ার্কের ক্যাপাসিটি কম থাকায় কানেক্টিভিটি নিয়ে এখানকার মানুষ সমস্যায় ভুগছিলেন। দ্বীপাঞ্চল হওয়ায় উন্নত নেটওয়ার্ক না থাকলে একেবারে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে এই এলাকার মানুষ। তাই, কটকার অধিবাসীদের জরুরি নেটওয়ার্ক সমস্যা সমাধানে প্রায় দশ ঘণ্টা স্টিমার যাত্রা শেষে ভোর ৬টায় কটকায় পৌঁছান তিনি। শীতকাল বিধায় তখনো সূর্যের আলো ফোটেনি। একা যাচ্ছেন শুনে যাত্রাপথে অনেকেই তাঁকে সাবধান করেন যে, বানর, শূকর, সাপ ইত্যাদি বন্যপ্রাণীর জন্য একা কটকায় যাওয়া বেশ ঝুঁকিপূর্ণ। এমনকি এখানে বাঘের দেখা পাওয়াও বিস্ময়কর কিছু নয়। কিন্তু তখন অন্যান্য সবাইও জরুরি সেবাদানে ব্যস্ত ছিলো অন্যান্য সাইটে। তাই, একাই রওনা দেন তিনি। সামান্য ভয় পেলেও দমে যাননি সাহসী সাদ্দাম। স্টিমার থেকে নেমে একাই রওনা দিলেন টাওয়ারে, আত্মরক্ষার জন্য সাথে রাখলেন লাঠি। টাওয়ারের দরজা খুলে দেখেন ঘুটঘুটে অন্ধকার। এরই মাঝে শুরু করলেন কটকার ৪জি নেটওয়ার্কের ক্যাপাসিটি আপগ্রেডের কাজ। কাজ করার সময় ঘরের দরজার বাইরে দেখা মিলল বন্য শূকরের। কিন্তু তাতে ভয় পেয়ে থেমে যাওয়ার মানুষ তিনি নন। তিনি জানেন তিনি থেমে গেলে, থেমে যাবে এ অঞ্চলের মানুষের নেটওয়ার্ক সম্পর্কিত সকল কাজের গতি। তাই, দ্বিতীয়বার না ভেবে দরজার কপাট লাগিয়ে একাই কাজ করে গেলেন। নেটওয়ার্কের ক্যাপাসিটি বাড়ানোর কাজ শেষে কটকায় উন্নত মানের নেটওয়ার্ক নিশ্চিত করে দুই ঘণ্টা পর রওনা দেন ঢাকার উদ্দেশ্যে।
দেশজুড়ে উন্নত নেটওয়ার্কের সফলতার পেছনের গল্পটা কখনো প্রচেষ্টার, কখনো দুঃসাহসের, কখনো আবার কল্পকাহিনীর মতোই অবিশ্বাস্য। নেটওয়ার্ক সম্প্রসারণে ও গ্রাহক সন্তুষ্টি নিশ্চিত করতে সায়াদাত আর সাদ্দামের মতো হুয়াওয়ের অসংখ্য নিবেদিত ইঞ্জিনিয়ার লকডাউনে কাজ করে গেছেন বিরামহীন। একনিষ্ঠতা ও কর্তব্যপরায়ণতার জন্য তাঁদের নিজেদের কর্মচারীদের সাধুবাদ জানায় হুয়াওয়ে। কারণ পরিস্থিতি যেমনই হোক, কাজের সাথে আপোষ করতে রাজি নন এর কর্মীরা। তাঁদের এসব প্রচেষ্টার কথা সকলের অগোচরেই থেকে যায়। হুয়াওয়ে দেশের মানুষের প্রযুক্তিগত নানা সমাধানে জন্য কাজ করে যাচ্ছে নিরলসভাবে। লকডাউনে প্রযুক্তি ও ইন্টারনেটের ব্যবহার বৃদ্ধি পাওয়ায় দেশে ডিজিটালাইজেশন ত্বরান্বিত হয়েছে, সাথে যুক্ত হয়েছে নেটওয়ার্ক সংক্রান্ত সেবার চাহিদা। এমন সব কর্মী করোনাকালেও নিষ্ঠার সাথে কাজ করে মানুষের সকল চাহিদা পূরণ করে ডিজিটাল বাংলাদেশ নির্মাণের স্বপ্ন বাস্তবায়নের পথে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন আরও এক ধাপ।
বিডি-প্রতিদিন/সালাহ উদ্দীন