সারাবিশ্বে ‘রন্ধন শিল্পের গুরু’ হিসেবে সার্টিফিকেট প্রাপ্ত নাজিম খান বললেন, ট্রিলিয়ন ডলারের এ সেক্টরে বাঙালিদের সম্পৃক্ত করতে যে ধরনের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা প্রয়োজন, তা বাস্তবে দেখা যাচ্ছে না। আমি সে লক্ষ্য অর্জনে কাজ করতে চাই। ইতিমধ্যেই ঢাকার বিশিষ্ট শেফের নেতৃত্বে ‘শেফ ফেডারেশন অব বাংলাদেশ’ গঠিত হয়েছে। করোনা পরিস্থিতি মোটামুটি শান্ত হলে মার্চের মধ্যে ঢাকায় যাবার ইচ্ছা আছে। সে সময় হাতে-কলমে রান্না শেখাবো। আন্তর্জাতিক মানের ‘রন্ধন শিল্পী’ বানানোর সত্যিকারের প্রয়াস নেব। এক্ষেত্রে সরকারের সহযোগিতা পেলে খুবই ভালো হবে। আমি বেতন চাই না, পারিশ্রমিকও নেব না। তবে এই সেক্টরকে বাস্তবতার আলোকে সাজাতে রাষ্ট্রের পৃষ্টপোষকতার ভীষণ প্রয়োজন।
পুরান ঢাকার উর্দু রোডের সম্ভ্রান্ত এক মুসলিম পরিবারের সন্তান নাজিম খান বলেন, ‘এই শিল্পের ভাষা হচ্ছে ইংরেজী। তাই রন্ধন শিল্পী হিসেবে যারা ট্রেনিং নিতে চান, তাদেরকে সবকিছু ইংরেজীতে শিখতে হবে। তাহলেই আন্তর্জাতিক মার্কেটে জায়গা করে নেয়া সম্ভব হবে। ভারত এবং শ্রীলংকানরা ইতিমধ্যেই তা করতে সক্ষম হয়েছেন।’
রন্ধন শিল্পে সর্বোচ্চ স্বীকৃতি হচ্ছে ‘ওয়ার্ল্ড শেফ সার্টিফাইড এক্সিকিউটিভ শেফ’। ৩০ নভেম্বর দুর্লভ এই সম্মান পেয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের নেব্রাস্কা স্টেটের লিঙকন সিটিতে ‘ব্রায়ান মেডিকেল সেন্টার’র ব্রায়ান হেলথ পরিচালিত রেস্টুরেন্টের এক্সিকিউটিভ শেফ নাজিম খান (৪৯)। এই স্বীকৃতি হচ্ছে আন্তর্জাতিক মানের সর্বোচ্চ সম্মান এবং ‘রন্ধন শিল্পী’র জন্যে ‘আজীবন সম্মাননা’র সামিল। সারাবিশ্বে এ যাবত ৬৫০ জন এ যোগ্যতা অর্জন করেছেন, যারমধ্যে ৭৭ জনই আমেরিকার। প্রথম বাংলাদেশী হিসেবে এ সম্মানে নাম লিখালেন ঢাকার উর্দু রোডের মোকাদ্দেস আলী খানের পুত্র নাজিম খান। তিনি বললেন, ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবস, ২১ ফেব্রুয়ারি ভাষা দিবস, ২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবস এলেই হৃদয়পটে ভেসে উঠে শৈশব-কৈশোরের সবস্মৃতি। পুরান ঢাকার অলি-গলিতে ভেসে বেড়াই দু’চোখ বন্ধ করে। সাড়ে ১২ হাজার কিলোমিটার দূরে থেকেও লাল-সবুজের বাংলাদেশ, প্রিয় প্রতিবেশীদের কথা ভুলতে পারি না বলেই মাতৃভ’মির প্রতি দায়বদ্ধতা কিছুটা হলেও লাঘব করতে চাই।
নাজিম খান বললেন, এই সার্টিফিকেটের পথ পরিক্রমা সহজ নয়। ১৯৯২ সালে ২১ বছর বয়সে যুক্তরাষ্ট্রে আসার পর জর্জিয়ার একটি কলেজে ব্যবসা-প্রশাসনে ভর্তি হয়েছিলাম। দু’বছর পড়ার পর আর মন বসাতে পারিনি। আর্থিক সংকটও এজন্যে দায়ী ছিল। এরপর নিউইয়র্কে যাই। জীবিকার জন্যে মনোনিবেশ করি। ১৯৯৭ সালে নিউইয়র্কে একটি জাপানি রেস্টুরেন্টে কাজ শুরু করি। সেই যে শুরু, আর পেছনে তাকানোর সময় পাইনি। নিষ্ঠার সাথে কাজ করে বহুজাতিক সমাজের রুচিসম্মত খাদ্য রান্নার যোগ্যতা অর্জন করেছি। বড় বড় হোটেলে শেফ হিসেবে কাজের সময়েই রান্নার প্রস্তুতি-প্রণালী শিখে নিয়েছি অভিজ্ঞজনের কাছে থেকে। এভাবেই টাইমস স্কোয়ারের ম্যারিয়ট মারক্যুইস, লং আইল্যান্ড ম্যারিয়ট, ডাউনটাউন ম্যানহাটানের ব্যাটারি পার্কে রিটজ কার্লটন, ডাবল ট্রি হোটেলে চীফ শেফ হিসেবে কাজের পর ২০১২ সালে বসন্ত এবং গ্রীষ্মে এডজাঙ্কট টিচার হিসেবে রন্ধন শেখাই প্রতিশ্রুতিশীল আমেরিকানদের। এরপর পুনরায় আন্তর্জাতিক মানের হোটেলে চীফ শেফ, এক্সিকিউটিভ শেফ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছি। সাবেক ফার্স্টলেডি মিশেল ওবামার জন্যেও বিশেষ একটি রান্না করেছিলেন নাজিম খান। নিকোল কিডম্যান এবং অ্যালেক বল্ডউইনের মতো হলিউডের খ্যাতনামা অভিনেতারাও প্রশংসা করেছেন নাজিম খানের রান্না খেয়ে।
এভাবেই নিজের স্থান করে নিয়েছেন ‘যুক্তরাষ্ট্র কুলিনারি ফেডারেশন’ও।
এই ফেডারেশন তাকে ‘সার্টিফাইড এক্সিকিউটিভ শেফ’ উপাধি দিয়েছে ২০০৭ সালে। অর্থাৎ এরপরই বিশ্বের সেরা রন্ধনশিল্পী’র প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণের পথ সুগম হয়েছে নাজিম খানের।
এ প্রসঙ্গে ২১ ডিসেম্বর সোমবার সন্ধ্যায় নাজিম খান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, কানাডা, যুক্তরাজ্য, অষ্ট্রেলিয়া, জার্মানী, ফ্রান্স প্রভৃতি দেশের কুলিনারি ফেডারেশন থেকে ‘সার্টিফাইড এক্সিকিউটিভ শেফ’রা ‘ওয়ার্ল্ড শেফ সার্টিফাইড মাস্টার শেফ’ প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণের যোগ্যতা অর্জন করেন। চূড়ান্ত পর্বে পৌঁছানোর আগে ৪টি ধাপ অতিক্রম করতে হয়। শুধু পুষ্টিকর খাদ্য রান্না করাই নয়, সে খাদ্যের উপকরণ কতটা কমদামে সংগ্রহ করা যায়, কতটা দৃষ্টিনন্দনভাবে পরিবেশন করা যায়, চার জনের খাদ্য তৈরীর নির্দেশ থাকলে পরিমাণ মত রান্না করতে হয়, কমবেশী হলেই ছিটকে পড়তে হয় প্রতিযোগিতা থেকে, রান্নার পর সেই খাদ্য মানুষের পছন্দের শীর্ষে উঠতে হয়, পরিমাণমত তাপমাত্রায় রান্না ও সংরক্ষণ করতে হয়; নির্দিষ্ট ফি দিয়ে বসতে হয় কয়েক দফা পরীক্ষায়। দেখাতে হয় নিজের রান্নার দক্ষতা। দেশ-বিদেশের বিচারকদের সামনে খাবার নিয়ে নিজের মুনশিয়ানা দেখিয়ে খুশি করতে পারলে তারপর মেলে রান্নার এ বিশেষ সার্টিফিকেট। এ ধরনের বহুবিধ পরিক্রমা যথাযথভাবে অনুসরণ করতে ৬ মাসের মত সময় লাগে। তারপরই ফান্সে অবস্থিত ‘ওয়ার্ল্ড এসোসিয়েশন অব শেফ সোসাইটি’ থেকে সারাবিশ্বে সেরা শেফের সার্টিফিকেট মেলে। এজন্যে দরকার প্রচন্ড ধৈর্য আর অধ্যাবসায়ের।
মিষ্টভাষী নাজিম বলেন, দেশ-বিদেশের অনেক রান্নাবিদের নামের আগে ‘মাস্টার শেফ’ লেখা থাকে। তাদের অনেকেই রান্নাবান্নার প্রতিযোগিতা ‘মাস্টার শেফ’ অনুষ্ঠানে বিজয়ী হওয়ার কারণে এটি লিখে থাকেন। এর সঙ্গে এই ‘মাস্টার শেফ’র পার্থক্য বিস্তর। যারা নিয়মিত খাবার ও রান্নার খোঁজ রাখেন, তারা জানেন ‘সার্টিফায়েড মাস্টার শেফ’ মূলত: রান্নাশিল্পের একটি বিশেষ সার্টিফিকেট, যা বিশ্বের বেশ কয়েকটি দেশ থেকে দেওয়া হয়।
নিউইয়র্কে আসমা খানকে ১৯৯৬ সালে প্রেম করে বিয়ের পর একমাত্র সন্তান নোহাদ আলী খানের জন্ম নিউইয়র্কে এবং বর্তমানে সে দশম গ্রেডের ছাত্র। পুত্রের দেখভালেই পুরো সময় ব্যয় করেছেন আসমা খান। তবে এখন তিনি একটি কাজে মনোনিবেশ করেছেন নেব্রাস্কাতেই।
২০১৫ সাল থেকে নাজিম খান নেব্রাস্কার ব্রায়ান হেলথ মেডিকেল সেন্টারের (যুক্তরাষ্ট্রের একটি বড় মেডিকেল ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল) রান্নাঘর সামলাচ্ছেন এক্সিকিউটিভ শেফ হিসেবে। তার অধীনে এখন প্রায় ৩০০ কর্মী (কুক ও শেফ) সেখানকার চিকিৎসক, শিক্ষার্থী, কর্মকর্তা, রোগী ও অতিথিদের জন্য খাবার তৈরি করেন।
যখন থেকে নাজিম খানের রান্নার প্রতি ভালোবাসা জন্মেছে, তখন থেকেই তিনি চেষ্টা করেন খাবারে অভিনবত্ব আনতে। তবে নিজের খাদ্যাভাসে তেমন পরিবর্তন সাধনে সক্ষম হননি। রক্ত-মাংসে বাংলার ডাল-ভাত আর মাছের ঝোল তার প্রতিদিনের খাদ্য তালিকায় থাকতে হয়। অন্যথায় নিজেকে বাঙালি ভাবতে পারেন না বলে মন্তব্য করলেন নাজিম খান। ভাত-ডালের স্মৃতিচারণ করতে করতে নাজিম হারিয়ে গেলেন ব্যস্ততম পুরান ঢাকায়। বললেন, ‘একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সময় আমি তো খুবই ছোট ছিলাম। ডাল খেতে ভালোবাসতাম। অনেক সময় বাসায় ডাল না থাকলে দাদি প্রতিবেশীর বাড়ি থেকে চাল দিয়ে ডাল নিয়ে আসতেন।’
ভিন্ন এবং অপরিচিত একটি পরিবেশে বিশ্বমানের রুচিসম্মত রান্নার জন্যে প্রয়োজন ৩টা পি। প্যাশন, পেশেন্স এবং পার্সিসট্যান্সী। এটি যিনি মেনে চলতে পারবেন তাকে কেউ ঠেকিয়ে রাখতে পারবে না বলে উল্লেখ করলেন নাজিম খান। তিনি বললেন, আমার এই বিশেষ পারদর্শিতাকে নেব্রাস্কা স্টেট প্রশাসন কাজে লাগানোর অভিপ্রায়ে ‘নেব্রাস্কা স্টেট ফুড কাউন্সিল’র মেম্বার হিসেবে মনোনীত করেছেন স্টেট গভর্নর।
বিডি-প্রতিদিন/সালাহ উদ্দীন