মিয়ানমারের বিরুদ্ধে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণে জাতিসংঘ সাধারণ অধিবেশনের এজেন্ডা নির্ধারণে সহায়তাকারি থার্ড কমিটির রেজ্যুলেশনে কখনোই চীন বা রাশিয়া পক্ষে ভোট দেয়নি। ভারতও প্রায় একইভাবে পক্ষে ভোট দেয়নি। ২০১১ সালে মিয়ানমার সংক্রান্ত এরকম রেজ্যুলেশনে ভারত বিপক্ষে ভোট দিয়েছিল। এবার তারা ভোট দানে বিরত থেকেছে। এটি অবশ্যই একটি ইতিবাচক দিক সামগ্রিক পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে।
২০১১ সালের রেজ্যুলেশনেও চীন এবং রাশিয়া পক্ষে ভোট দেয়নি। ২০১২ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত প্রতি বছরই মিয়ানমারের ব্যাপারে এই থার্ড কমিটির রেজ্যুলেশন গৃহিত হয়েছে কোন ভোট গ্রহণ ছাড়াই। ২০১৬ সালে মিয়ানমার নিয়ে কোন প্রস্তাব থার্ড কমিটিতে উঠেনি। এবার পরিস্থিতির চরম অবনতি ঘটায় ওআইসি (ইসলামিক সম্মেলন সংস্থা) এর পক্ষ থেকে এ রেজ্যুলেশনের প্রস্তাব পেশ করা হয়েছিল। আগের প্রস্তাব উঠেছিল ইউরোপিয় ইউনিয়নের পক্ষ থেকে।
স্মরণ করা যেতে পারে যে, মিয়ানমারে মানবাধিকার পরিস্থিতির আলোকে থার্ড কমিটিতে রেজ্যুশেনের প্রস্তাবটি বাংলাদেশের ছিল না। তবে, ২০১১ সালের তুলনায় এবার রেজ্যুলেশনটির পক্ষে ভোটের সংখ্যা অনেক বেড়েছে। ২০১১ সালে তা ছিল ৯৮। এবার হয়েছে ১৩৫। একইভাবে এবার বিপক্ষে ভোট পড়েছে মাত্র ১০টি। ২০১১ সালে ছিল ২৫। ভোটদানে বিরত ছিল এবার ২৬টি দেশ। ২০১১ সালে ছিল ৬৩টি দেশ। ২০১১ সালে ভারত ‘নো’ ভোট দিলেও এবার ছিল ‘বিরত’।
শুধু মিয়ানমার কেন, অন্য যে কোন দেশের ব্যাপারেই রাশিয়া, চীন এবং ভারতের অবস্থান একই। যেমন, ২০১১ সাল থেকে চলতি বছর পর্যন্ত ইরানের মানবাধিকার পরিস্থিতির ওপর থার্ড কমিটির রেজ্যুলেশনে রাশিয়া, চীন এবং ভারত ‘না’ ভোট দেয়। সিরিয়ার মানবাধিকার পরিস্থিতির ওপর থার্ড কমিটির রেজ্যুলেশনের ভোটে ২০১১ সালে এই ৩টি দেশ ‘বিরত’ থাকলেও ২০১২ সাল থেকে চলতি বছর পর্যন্ত রাশিয়া এবং চীন ‘নো’ ভোট দেয়।
অপরদিকে ভারত ভোটদানে ‘বিরত’ থেকেছে। কোরিয়ার ব্যাপারেও ২০১১ সালে রাশিয়া এবং চীন ‘নো’ ভোট দিলেও ভারত ‘বিরত’ থেকেছে। গত বছর এবং চলতি বছরও থার্ড কমিটিতে কোরিয়ার রেজ্যুলেশন হয়েছে কোন ভোট ছাড়াই। নির্দিষ্ট কোন রাষ্ট্রের ব্যাপারে রেজ্যুলেশন গ্রহণের ভোট প্রদানে রাশিয়া, চীন এবং ভারতের মনোভাব প্রায় একইরকম বিধায় এবার মিয়ানমারের বিরুদ্ধে রেজ্যুলেশনের ভোট প্রদানেও একই মনোভাবের প্রকাশ ঘটেছে। চীন বা রাশিয়া ‘কান্ট্রি স্পেসিফিক’ কোনো রেজুলেশনে এ পর্যন্ত পক্ষে ভোট দেয়নি।
জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের তৃতীয় কমিটির ভোট-বিশ্লেষণে দেখা যায়, এবারই প্রথম কিউবা, ভেনিজুয়েলা, নিকারাগুয়া তাদের পজিশন চেঞ্জ করেছে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে রেজ্যুলেশনের ক্ষেত্রে।
এবার থার্ড কমিটিতে নির্দিষ্ট কোন দেশের বিরুদ্ধে রেজ্যুলেশনের সময় সবচেয়ে বেশি ভোট পড়েছে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে। একইভাবে সবচেয়ে কম ভোট পড়েছে রেজ্যুলেশনের বিরুদ্ধে। সবকটি রেজ্যুলেশনের ভোট প্রক্রিয়ার বিশ্লেষণে আরো দেখা যায় যে, মিয়ানমারের বিরুদ্ধে ভোট প্রদানে বিরত থাকা রাষ্ট্রের সংখ্যাও খুবই কম। আর এর মধ্যদিয়েই মিয়ানমারে রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে চলমান বর্বরতা নিয়ে সারাবিশ্বের উদ্বেগ-উৎকন্ঠার স্পষ্ট প্রকাশ ঘটেছে।
ওআইসি দেশসমূহের মধ্যে ইরান, উজবেকিস্তান, টার্কমেনিস্তান, চাদ এবং ক্যামেরুন সাধারণত: থার্ড কমিটির ভোটে ‘না’ কিংবা ‘বিরত’ থাকে। এবার এই রেজ্যুলেশনে তারা ছিল অনুপস্থিত। এরফলে রেজ্যুলেশনের বিপক্ষে ভোট সংখ্যা কমেছে। ওআইসিভুক্ত আলজেরিয়া, আযারবাইজান, ব্রুনাই, মিশর, উমান, সেনেগাল, সুদান, সিয়েরা লিয়োন, গীনিয়া এবং সোমালিয়া এর আগে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে রেজ্যুশেনের ভোটে অনুপস্থিত থাকলেও এবার তারা পক্ষে ভোট দিয়েছে। সিরিয়ার ওআইসি সদস্য পদ সাসপেন্ড থাকায় এই রেজ্যুলেশনের স্পন্সরশীপে থাকতেও অনীহা প্রকাশ করে। যদিও তারা ভোট দিয়েছে বিপক্ষে।
মিয়ানমারের বিরুদ্ধে রেজ্যুশেনের ভোটে আগে যারা বিরত থাকতো সে সব রাষ্ট্র এবার পক্ষে ভাট দিয়েছে। এগুলো হচ্ছে এঙ্গোলা, বাহরাইন, বারবাডোস, বেনিন, ব্রাজিল, বারকিনা ফ্যাসো, কলম্বিয়া, কমরোস, ডিজিবুটি, গাম্বিয়া, গুয়াতেমালা, গায়ানা, ইন্দোনেশিয়া, জর্দান, কুয়েত, কিরগিস্তান, মাডাগাস্কার, মালাওয়ি, মালয়েশিয়া, মালি, মরিতানিয়া, মরক্কো, মুজাম্বিক, নাইজার, নাইজেরিয়া, পাকিস্তান, পাপুয়া নিউগিনী, কাতার, রুয়ান্ডা, সেইন্ট কিটস এ্যান্ড নেভিস, সউদি আরব, সাউথ সুদান, তাজিকিস্তান, উগান্ডা, সংযুক্ত আরব আমিরাত, ইয়েমেন, জাম্বিয়া। এরমধ্যে ওআইসির সদস্যও রয়েছে ২৩টি।
আগে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে ভোট দিলেও এবার বিরত ছিল মঙ্গোলিয়া, টগো, টঙ্গা, তাঞ্জানিয়া, জাপান এবং কিরিবটি। আগে ভোট দিলেও এবার অনুপস্থিত থাকা রাষ্ট্রগুলো হচ্ছে আরমেনিয়া, সারবিয়া, সিসিলিস, সাও টমি এবং প্রিন্সিপি।
কিউবা, নিকারাগুয়া এবং ডিপিআরকে আগে বিপক্ষে ভোট দিলেও এবার অনুপস্থিত ছিল। ভারত, শ্রীলংকা, ভেনেজুয়েলাও আগে বিপক্ষে ভোট দিয়েছে। তবে এবার বিরত ছিল। আসিয়ান দেশসমূহের মধ্যেও এবার বিভক্তি ঘটেছে। ওআইসি মেম্বার মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, ব্রুনাই রেজ্যুলেশনের পক্ষে ভোট দিলেও লাউস, কম্বোডিয়া, ফিলিপাইন, ভিয়েতনাম, মিয়ানমার ‘নো’ ভোট দিয়েছে। থাইল্যান্ড এবং স্ঙ্গিাপুর ছিল বিরত। আগে বিরত থাকতো টার্কমেনিস্তান, ত্রিনিদাদ এ্যান্ড টবাগো। এবার তারা ছিল অনুপস্থিত। ইসরাইল রেজ্যুলেশনের পক্ষে ভোট দিয়েছে।
ভোটের এই গতি-প্রকৃতির জন্যে বাংলাদেশের কূটনৈতিক তৎপরতার প্রশংসা করা হচ্ছে বিভিন্ন মহলে। জাতিসংঘের শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তা ছাড়াও বাংলাদেশ এবং সমসাময়িক বিশ্ব নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করেন-এমন রাষ্ট্র ও সমাজবিজ্ঞানীরাও থার্ড কমিটির রেজ্যুলেশনে ভোটের সংখ্যা বৃদ্ধি এবং না ভোটের সংখ্যা হ্রাসের কৃতিত্ব বাংলাদেশের ‘বিচক্ষণতাপূর্ণ কূটনৈতিক তৎপরতা’কে দিচ্ছেন।
জাতিসংঘে বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধি ও রাষ্ট্রদূত মাসুদ বিন মোমেন এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘ঢাকার নির্দেশ অনুযায়ী সম্মিলিত একটি তৎপরতার ফসল এটি। এভাবেই আমরা বাংলাদেশের সামগ্রিক বিষয় নিয়ে একযোগে কাজ করছি। জাতিসংঘ সদর দফতরেও সকলের মধ্যে রোহিঙ্গা ইস্যুটি ব্যাপকভাবে নাড়া দিয়েছে।’
প্রসঙ্গত: উল্লেখ্য যে, সাধারণ পরিষদের থার্ড কমিটিতে ১৬ নভেম্বর বৃহস্পতিবার পাস হওয়া এই প্রস্তাবে জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেসকে মিয়ানমার বিষয়ে একজন বিশেষ দূত নিয়োগ করতে বলা হয়েছে। রাখাইন প্রদেশে রোহিঙ্গা মুসলিমদের উপর মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর অভিযানের এখনি ইতি টানতে বলেছে জাতিসংঘ কমিটি। রোহিঙ্গাদের পূর্ণ অধিকার দিয়ে নাগরিকত্ব দেওয়ার আহ্বানও জানানো হয়েছে পাস হওয়া প্রস্তাবে।
থার্ড কমিটি রাখাইনে জাতিসংঘ প্যানেলকে অবাধে কাজ করতে দিতেও মিয়ানমার সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে।
সাধারণ পরিষদের এজেন্ডা নির্ধারণী অন্যতম ফোরাম থার্ড কমিটি মানবাধিকার লঙ্ঘন, নারী ও শিশু সুরক্ষা, আদিবাসীদের অধিকার রক্ষার বিষয়গুলো নিয়ে কাজ করে। সামরিক শাসনে থাকা মিয়ানমারে মানবাধিকার হরণের নিন্দা জানিয়ে গত দেড় দশক ধরে দেশটির বিরুদ্ধে প্রস্তাব গ্রহণ করে আসছিল থার্ড কমিটি।
বিডি-প্রতিদিন/ সালাহ উদ্দীন