সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বিশ্বকে অগ্রগতির পথে ধাবিত করতে পারে এমন চিন্তা-চেতনা তথা আরও সুন্দর ভবিষ্যৎ রচনায় সক্ষম চিন্তা-চেতনার অধিকারী হিসেবে বিশ্বের সেরা ৫০ চিন্তাবিদের একজন হলেন বাংলাদেশি-আমেরিকান সুবীর চৌধুরী। লন্ডনের ফাইন্যান্সিয়াল টাইমস দু’বছর অন্তর এ তালিকা প্রকাশ করে। এটি ব্যবস্থাপনার জগতে ‘অস্কার অব ম্যানেজমেন্ট থিঙ্কিং’ (Oscars of Management Thinking) হিসেবেও সমাধিক খ্যাত। এ কর্মসূচি চালু হয়েছে ২০০১ সাল থেকে। এবারের তালিকা প্রকাশ করা হয় গত রবিবার লন্ডনে ড্র্যাপার্স মিলনায়তনে বর্ণাঢ্য এক অনুষ্ঠানে। ৫০ জনের মধ্যে সুবীর চৌধুরী একমাত্র বাঙালি এবং এশিয়া মহাদেশে ৬ জনের একজন। তালিকায় ভারতের ৪ এবং চীনের একজন রয়েছেন।
চট্টগ্রামের বোয়ালখালি উপজেলার গুমদন্দি গ্রামের সন্তান সুবীর চৌধুরী (৪৮) গত মাসে বিশ্বব্যাংক প্রেসিডেন্ট জিম ইয়ং কিমের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য হিসেবে কাজ শুরু করেছেন। স্ত্রী মালিনী চৌধুরী এবং দুই সন্তান আনন্দি এবং আণিষকে নিয়ে ক্যালিফোর্নিয়া অঙ্গরাজ্যের লসএঞ্জেলেস সিটিতে প্রশান্ত মহাসাগরের তীর ঘেষে মনোরম পরিবেশে বাস করেন। তার আগে ২০১১ এবং ২০১৩ সালেও ‘থিঙ্কার্স৫০’ তালিকাভুক্ত হয়েছিলেন। এবার ৩০টি দেশ থেকে ২০ সহস্রাধিক দক্ষ-ব্যবস্থাপকের নাম জমা হয়েছিল। যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, বাংলাদেশ, ডেনমার্ক, নেদারল্যান্ড, চীন, যুক্তরাজ্য, ভারত ও কিউবার ৫০ জন পেলেন কর্পোরেশনের ব্যবস্থাপনায় বিচক্ষণতাপূর্ণ অবদানের এ স্বীকৃতি।
থিঙ্কার্স৫০ তালিকা সম্পর্কে এর উদ্যোক্তারা উল্লেখ করেছেন যে, মানবতার সামগ্রিক কল্যাণে ব্যবস্থাপনা জগতে সেরা মেধাবীদের তালিকার ক্ষেত্রে ‘থিঙ্কার্স৫০’ এখনো অতুলনীয়।
‘পরিবর্তিত পরিস্থিতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে দক্ষতাপূর্ণ ব্যবস্থাপনায় অসাধারণ প্রক্রিয়া অবলম্বনে যারা বিশেষ খ্যাতি প্রদর্শনে সক্ষম হচ্ছেন, তাদের ভাগ্যেই জুটেছে এই স্বীকৃতি’। বৃহস্পতিবার রাতে সুবীর চৌধুরী বলেন, ‘বাংলাদেশের নেতিবাচক সংবাদই শুধু বিশ্বব্যাপী ফলাও করে প্রকাশিত হচ্ছে। বাংলাদেশ শুধু হরতাল-অবরোধ আর জ্বালাও-পোড়াওয়ের দেশ নয়, বাঙালির মেধা গোটা বিশ্বে পরিবর্তনে অবদান রাখছে। এ স্বীকৃতি সে কথারই বহিঃপ্রকাশ ঘটালো।’ তিনি বলেন, 'এটি পেয়ে আমি অত্যন্ত গৌরববোধ করছি এ জন্যে যে, বাংলাদেশের বাঙালিরা নিষ্টা ও সততার সঙ্গে কাজ করলে কেউ তাদের ঠেকিয়ে রাখতে পারবে না। মেধার স্বীকৃতি আসবেই। আর এভাবেই বিশ্বের মাঝে বাংলাদেশ ক্রমাগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে’।
৩৯ নম্বর ক্রমিকের সুুবীর চৌধুরীকে বিশ্বে ম্যানেজমেন্ট জগতের লোকজন ‘দ্য কোয়ালিটি প্রফেট’ হিসেবে বিবেচনা করে। ম্যানেজমেন্টের ওপর তার লেখা বহু বই যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠ্য হিসেবে পরিণত হয়েছে। বিশেষ করে ‘দ্য পাওয়ার অব সিক্স সিগমা’ গ্রন্থটি বড় বড় কর্পোরেশনের ব্যবস্থাপনায় যুগান্তকারী নির্দেশক হিসেবে পরিগণিত হয়েছে। ২০১১ সালে প্রকাশিত ‘দ্য পাওয়ার অব এলইও’ গ্রন্থটি ব্যবসায় অসাধারণ সাফল্য আনার ক্ষেত্রে অবদান রেখে চলেছে।
সুবীর চৌধুরী বলেন, ২০১৭ সালে ‘দ্য ডিফারেন্ট’ নামক আরেকটি বই প্রকাশিত হবে। সে বইয়ে থাকবে বাংলাদেশের মত উন্নয়নে আগ্রহী বিশ্বের ব্যবস্থায় গতি আনার অনেক পরামর্শ।
চট্টগ্রাম সরকারি হাইস্কুল এবং চট্টগ্রাম সরকারি কলেজ থেকে বিশেষ কৃতিত্বের সঙ্গে উত্তীর্ণ হবার পর সুবীর চৌধুরী চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজেও ভর্তি হয়েছিলেন। কিন্তু মেডিক্যাল কলেজ ছেড়ে পরবর্তীতে ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি থেকে অ্যারোনটিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং-এ আন্ডার গ্র্যাজুয়েট করে উচ্চ শিক্ষার জন্যে ১৯৯১ সালে যুক্তরাষ্ট্রে পা রাখেন। মিশিগান অঙ্গরাজ্যের মাউন্ট প্লিজ্যান্ট সিটিতে অবস্থিত সেন্ট্রাল মিশিগান ইউনিভার্সিটি থেকে ইন্ডাষ্ট্রিয়াল ম্যানেজমেন্টে গ্র্যাজুয়েশন করেছেন ।
এরপর মিশিগানের জেনারেল মটর্স কোম্পানির ডেলফি ডিভিশনে কোয়ালিটি অ্যান্ড সিস্টেম ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে কাজ শুরু করেন।
১৯৯৮ থেকে ২০০৩ সাল পর্যন্ত তিনি আমেরিকান সাপ্লায়ার ইন্সটিটিউটের নির্বাহী ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের গাড়ি প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ দেন।
১৯৯৬ সালে ‘কিউএস-৯০০০ পায়োনিয়ার’ লিখে আলোচনায় আসা সুবীর চৌধুরীকে ‘দ্য লিডিং কোয়ালিটি এক্সপার্ট’ অভিহিত করেছে নিউইয়র্ক টাইমস।
২০০৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকত্ব পাওয়া সুবীরের মোট ১৪টি বই প্রকাশিত হয়েছে। কোয়ালিটি ও ম্যানেজমেন্টের ওপর প্রকাশিত এসব বই নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে আলোচনাও হয়েছে।
বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতিসহ বাংলাদেশের সামগ্রিক উন্নয়নে গবেষণার জন্যে তার দেয়া মিলিয়ন ডলার অনুদানে ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়ার বার্কলে ক্যাম্পাসে এ বছরের মার্চ থেকে চালু হয়েছে ‘সুবীর অ্যান্ড মালিনী চৌধুরী সেন্টার ফর বাংলাদেশ স্টাডিজ।’
বিডি-প্রতিদিন/ ১৪ নভেম্বর, ২০১৫/ রশিদা