মক্কা থেকে মদিনায় হিজরতের এক বছর না যেতেই বদর যুদ্ধের মুখোমুখি হয় মুসলমানরা। তার এক বছর না যেতেই ওহুদে বড় আঘাত আসে মুসলমান বাহিনীর ওপর। নূর নবীজির (সা.) জন্য সময়টা ছিল বেশ চ্যালেঞ্জিং। একদিকে যুদ্ধ, অন্যদিকে মুসলমানদের পরিশুদ্ধ করার কর্মশালা দুটোই একসঙ্গে পরিচালনা করতে হচ্ছে। যুদ্ধ একবার শুরু হলে সহজে শেষ হয় না, ব্যাপারটা নবীজি (সা.) জানতেন। তাই তিনি মুসলমানদের সামরিক ও নৈতিক দুই দিকেই গুরুত্ব দিচ্ছিলেন। মুসলমানরা একদিকে হবে তুখোড় যোদ্ধা, অন্যদিকে হবে প্রখর কোমল। শত্রুর প্রতি তারা ঝাঁপিয়ে পড়বে সিংহের মতো, আর সাধারণ মানুষের প্রতি বিছিয়ে দেবে মমতার ডানা। এ লক্ষ্য নিয়ে দিনরাত কাজ করে যাচ্ছেন হুজুর (সা.)। কিন্তু নবীজির পথে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে এক অদৃশ্য শত্রু- ‘গুজব’। মুসলমান বাহিনী এক পা এগোচ্ছে তো গুজবের কারণে দুই পা পিছিয়ে যাচ্ছে। আর এ গুজব রটনায় মুখ্য ভূমিকা পালন করছে মদিনার মুনাফিকরা। বুঝে না বুঝে তাদের ফাঁদে পা দিয়েছে নতুন মুসলমানরা।
পুরো ব্যাপারটি ইমাম বাগাবি (রহ.) খুব সুন্দর করে তুলে ধরেছেন। তাফসিরে মাজহারির লেখক আল্লামা কাজী সানাউল্লাহ তার তাফসিরে বিষয়টি এনেছেন। ইমাম বাগাবি বলেন, রসুল (সা.) মদিনার আশপাশ ও দূরদূরান্তে সেনাবাহিনী পাঠিয়ে যুদ্ধ পরিচালনা করতেন। কখনো তারা জয়লাভ করত কখনো বা পরাজয় বরণ করত। মুনাফিকরা নবীজির পাঠানো বাহিনীর হারজিতের খবরাখবর রাখতেন। বাহিনী জিতলে মুনাফিকরা ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে মিথ্যা সংবাদ বানিয়ে মদিনার ঘরে ঘরে প্রচার করে বেড়াত। বলত, থাকবে না, মুহাম্মদ (সা.)-এর মিশন আর থাকবে না। ওমুক এলাকায় তাঁর বাহিনী কুপোকাত। শত্রুদল মদিনা আক্রমণের জন্য বেরিয়ে পড়েছে। জীবন বাঁচাতে চাইলে পালিয়ে যাও। এ ধরনের আরও নানা কথা তারা রটিয়ে দিত। তাদের দেখাদেখি অনেক নতুন মুসলমানও এ খবর হাটে বাজারে ছড়িয়ে দিত। ব্যাপক প্রচারের কারণে মুসলমান সমাজে একধরনের ভয়-অস্থিরতা দেখা দিত। একইভাবে মুসলমানরা কোথাও আক্রমণের শিকার হলে মুনাফিকরা কখনো কখনো সত্য গোপন করে বলত- মুসলমানদের বিজয় আর বেশি দূরে নয়। মদিনার ঘরে ঘরে তখন একধরনের স্বস্তি বিরাজ করত। এতে করে শত্রুর আক্রমণের ব্যাপারে তাদের যে সাবধান থাকার প্রয়োজন ছিল সেটা কিছুটা শিথিলতা দেখা দিত কারও কারও ভিতর। এমন পরিস্থিতিতে নবীজি (সা.)-এর জন্য শান্তভাবে কাজ করা মুশকিল হয়ে পড়ল। মুসলমান সমাজের এই অস্থিরতা কিংবা বেশি স্বস্তিদায়ক অবস্থার কারণে বিশেষ সুবিধা পেত শত্রু পক্ষ। তারা নতুন করে সাজাত তাদের রণকৌশল।
এভাবে রাষ্ট্রের বিরোধী শক্তি মুনাফিকদের অপপ্রচারে প্রভাবিত না হওয়ার ব্যাপারে সাবধান করে দিয়েছেন আল্লাহতায়ালা। পাশাপাশি কোনো গুরুতর খবর চাই তা ভালো হোক বা মন্দ হোক, সেটা শোনার সঙ্গে সঙ্গেই প্রচার করা যাবে না। আগে যাচাই করতে হবে। পুরোপুরি নিশ্চিত হওয়ার পর তা জনগণের সামনে প্রকাশ করতে হবে। আল্লাহ বলেন, ‘তারা যখন শান্তি কিংবা ভয়ের কোনো খবর শুনে যাচাইবাছাই না করেই তা সমাজে ছড়িয়ে দেয়। অথচ তারা যদি বিষয়টি প্রথমে রসুলকে (সা.) জানাত কিংবা রাষ্ট্রের দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের বিষয়টি জানাত তাহলে রাষ্ট্রে যারা অনুসন্ধানের কাজে নিয়োজিত, তারা খবরটি যাচাই করে সত্য নির্ণয় করতে পারত। তোমাদের প্রতি যদি আল্লাহর অনুগ্রহ না থাকত তাহলে অল্প কয়েকজন ছাড়া বাকি সবাই গুজব রটনাকারী শয়তানের অনুসারী হয়ে পড়ত (সুরা নিসা, আয়াত ৮৩)।’
আয়াতে একটি শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে, ‘ইয়াসতানবিতুনাহও’। শব্দটি এসেছে ‘ইস্তেমবাত’ থেকে। ইস্তেমবাত মানে হলো কোনো কিছু উদঘাটন করা, আবিষ্কার করা, নির্ণয় করা ইত্যাদি। ভেজালের ভিড়ে খাঁটি খুঁজে বের করার ক্ষেত্রেও ইস্তেমবাত শব্দ ব্যবহার হয়। এ আয়াত থেকে বোঝা যায়, কোরআনি রাষ্ট্রের জন্য অবশ্যই চৌকশ গোয়েন্দা বাহিনী, সংবাদকর্মী ও জনপ্রতিনিধি প্রয়োজন। যারা অন্যান্য কাজের পাশাপাশি গুজব নামক তথ্য সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে দক্ষতার সঙ্গে লড়াই করতে পারবে। আজকের বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বেই মহামারি আকার ধারণ করেছে গুজব। ফেসবুক, ইউটিউব খুললেই এক শটা খবরের মধ্যে নব্বইটাই থাকে গুজব। আর মানুষও সত্য খবরের চেয়ে গুজবই বিশ্বাস করে বেশি। এমন পরিস্থিতিতে কোরআনের নির্দেশনা হলো, ভালোমন্দ যে খবরই আসুক না কেন সঙ্গে সঙ্গেই তা পাবলিক প্ল্যাটফর্মে ছড়িয়ে দেওয়া যাবে না। বিষয়টি প্রথমে রাষ্ট্রের দায়িত্বশীল কর্তৃপক্ষের নজরে আনতে হবে।
লেখক : প্রিন্সিপাল, সেইফ এডুকেশন ইনস্টিটিউট, পীর সাহেব, আউলিয়ানগর
বিডি প্রতিদিন/এমআই