প্রতিদিনের জীবনে কত কথাই না বলতে হয়। কাউকে কষ্ট না দিয়ে, পরনিন্দা না করে এবং অনর্থক কথন পরিহার করে সদা সত্য ও সুন্দর কথা বলা মানুষের অতি উত্তম গুণাবলির অন্যতম। কথায় ব্যবহৃত শব্দাবলির চয়ন ও বাক্যের গাঁথুনিতেও আছে ইসলামের নির্দেশনা।
অপমানজনক অর্থের সম্ভাবনাময় শব্দ পরিহার : অপমানজনক অর্থের আভাস আছে—এমন শব্দ পরিহার করতে হবে।
ভদ্রতা ও সম্মানার্থে ও বেয়াদবির ছিদ্রপথ বন্ধ করতে এমন শব্দের ব্যবহার একেবারেই ঠিক নয়। মহান আল্লাহ বলেন, হে মুমিনরা, তোমরা ‘রায়িনা’ বলো না; বরং ‘উনযুরনা’ বলো এবং শোনো। আর কাফেরদের জন্য যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি আছে। (সুরা বাকারা, আয়াত : ১০৪)
‘রায়িনা’ শব্দটি নির্দেশসূচক। এর অর্থ—‘আমাদের প্রতি লক্ষ্য করুন। ’ সাহাবিরা এ শব্দটি রাসুলুল্লাহ (সা.) এর ক্ষেত্রে ব্যবহার করত। কিন্তু এটি ইহুদিদের ভাষায় এক প্রকার গালি ছিল, যা দ্বারা বোঝা হতো বিবেক বিকৃত লোক। তারা এ শব্দটি রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর শানে উপহাসসূচক ব্যবহার করত। মুমিনরা ব্যাপারটি উপলব্ধি না করে রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর শানে ব্যবহার করা শুরু করলে আল্লাহ তাআলা তা পরিহার করতে বলেন। সেই সঙ্গে ‘উনযুরনা’ বলার নির্দেশনা দেন। এ শব্দে ইহুদিদের হীনস্বার্থ চরিতার্থ করার কোনো সুযোগ নেই।
কাল ও সময়কে গালমন্দ নয় : কাল, সময় ও প্রকৃতিকে দোষারোপ করা হয়—এমন শব্দ ও বাক্য পরিহার করতে হবে। এমন শব্দ ও বাক্যের ব্যবহার কোনোভাবেই বৈধ নয়। কারণ রাত-দিন, সময়-কাল সব মহান আল্লাহর সৃষ্টি এবং তাঁর নির্দেশে পরিচালিত হয়। সূর্য যথানিয়মে উদিত হয়ে পৃথিবীকে আলো ও তাপ দেয়। গ্রহ-নক্ষত্র যথানিয়মে নিজ নিজ কক্ষপথ পাড়ি দেয়। এসবে কোনো হেরফের নেই। তবে জলবায়ুর পরিবর্তন মানুষের কৃতকর্মের ফল। কাল, সময় ও প্রকৃতির কোনো প্রভাব নেই। এ মর্মে হাদিস বর্ণিত হয়েছে। আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘মহান আল্লাহ বলেন, আদম-সন্তান আমাকে কষ্ট দেয়, সে সময়কে গালি দেয়, অথচ আমিই সময়, রাত ও দিন বিবর্তিত করে থাকি। ’ (মুসলিম, হাদিস : ২২৪৬)
নিষিদ্ধ বিষয়ের প্রতি অনুরাগী করে—এমন শব্দ পরিহার : আঙুর একটি বিশেষ ফল, যাকে আরবিতে ‘ইনাব বলে। ফলটি প্রাক-ইসলামী যুগ থেকে মাদক দ্রব্যের কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহার করা হয়। ফলে অনেক সময় মাদককে আকর্ষণীয় করে তুলতে বা মাদকের অনুরাগে মাদকের উৎস আঙুরকে কারম বলা হতো। কারম অর্থ—বদান্যতা ও মর্যাদাশীল। এমন শব্দ চয়ন মাদকের প্রতি আগ্রহ সৃষ্টি করতে পারে। মাদকের প্রতি অনীহা প্রকাশ ও এর নিষিদ্ধতাকে স্পষ্ট করতে হাদিসে আঙুরকে ‘ইনাব এর পরিবর্তে কারম বলতে বারণ করা হয়েছে। আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘তোমাদের কেউ আঙুরকে ‘ইনাব-এর পরিবর্তে কারম (বদান্যতা ও মর্যাদাশীল) বলবে না। কেননা কারম (বদান্যতা ও মর্যাদাশীল) হলো— মুসলিম ব্যক্তি। (মুসলিম, হাদিস: ২২৪৭)
অসংগত ও অসমীচীন শব্দ পরিহার : সব মানুষ মহান আল্লাহর দাস। ইবাদত-বন্দেগি ও দাসত্ব শুধু তাঁরই জন্য; অন্য করো জন্য নয়। কাজেই মানুষ মানুষের দাস হতে পারে না। সেবক হতে পারে। কাজেই কাউকে দাস-দাসি বলা মোটেই সংগত ও সমীচীন নয়। সেভাবে আল্লাহ ছাড়া কাউকে রব বা প্রতিপালক বলাও সংগত নয়। সে ক্ষেত্রে মনিব বলা যেতে পারে।
আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, তোমাদের কেউ ‘আবদি (আমার বান্দা) বলবে না। তোমাদের প্রত্যেকই আল্লাহর বান্দা। বরং বলবে—ফাতায়া (আমার বালক-কিশোর)। এভাবে কেউ তার মনিবকে রাব্বি (আমার প্রতিপালক) বলবে না; বরং বলবে আমার মনিব। (মুসলিম, হাদিস: ২২৪৯)
ঘৃণাত্মক জিনিসের সঙ্গে সম্পৃক্ত শব্দ পরিহার : ঘৃণাত্মক জিনিসের সঙ্গে সম্পৃক্ত শব্দাবলি পরিহার করে সত্য, সুন্দর, শান্তি ও নিরাপত্তার সঙ্গে সম্পৃক্ত শব্দাবলি প্রয়োগ করা উচিত। এতে সুস্থ ও সুন্দর রুচিবোধের প্রকাশ ঘটে। আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, কেউ নিজের দুরবস্থা প্রকাশ করতে বলবে না, আমার মন খবিস (পিশাচ, ইতর, নিকৃষ্ট) হয়ে গিয়েছে; বরং বলবে—আমার মন সংকুচিত ও বিমর্ষ হয়ে গিয়েছে। (মুসলিম, হাদিস: ২২৫০)
পরিশেষে বলা যায়, ইসলামের পূর্ণতা ও সুন্দরতার একটি অনন্য উদাহরণ হলো শব্দচয়নে ইসলামের নীতিমালা। কাজেই এসব বিষয়েও ঈমানদারদের সচেতন হওয়া জরুরি ।
লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, আরবি বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
বিডি-প্রতিদিন/সালাহ উদ্দীন