জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) যুগ্ম আহ্বায়ক সারোয়ার তুষার বলেছেন, সংস্কারের নামে ক্ষমতা প্রলম্বিত করার কোনো সুযোগ নেই। আমাদের এখন রাজনীতির পুরোনো বন্দোবস্তের সঙ্গে ফাইট দিতে হচ্ছে। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পরে রাজনীতিটা প্রবলভাবে কামব্যাক করেছে। গত ১৫ বছর রাজনীতিকে মাইনাস করা হয়েছিল। আওয়ামী লীগ নিজে একটি রাজনৈতিক দল হলেও তারা রাজনীতির স্পেসটা একেবারে নাই করে দিয়েছিল। শেষ পর্যন্ত একটি ব্যুরোকেটিক রাষ্ট্র করে ফেলেছিল পতিত দলটি। সব মিলিয়ে আমরা এখন ফ্যাসিবাদ থেকে গণতন্ত্রের দিকে যাচ্ছি। সম্প্রতি বাংলাদেশ প্রতিদিনের সঙ্গে সাক্ষাৎকারে সারোয়ার তুষার আরও বলেন, গণ অভ্যুত্থানের কারণটা আসলে নির্বাচন নয়। সংস্কারটা হচ্ছে কারণ। নির্বাচনটা হচ্ছে ফলাফল। এটা আসবেই। বাংলাদেশে অন্য কোনো পথ নেই। সংস্কারের নামে অনেক দিন ধরে ক্ষমতা প্রলম্বিত করার কোনো সুযোগ এখানে নেই। কারণ এটা ওয়ান-ইলেভেন না। সংস্কারের অনিবার্য ফল হিসেবে নির্বাচন আসবেই। এ ক্ষেত্রে সংস্কারটা গুরুত্বপূর্ণ। সংস্কার ও নির্বাচন প্রশ্নে আপনারা কোন পথে এগোবেন? এ প্রশ্নে সারোয়ার তুষার বলেন, আমরা সরকারের কাছে সংস্কারের রোডম্যাপটা পরিষ্কার করে জানতে চাই। যদিও জাতীয় ঐকমত্য কমিশন কাজ করছে। কিন্তু সেখানে পদ্ধতিগত বিষয় নিয়ে আমাদের অনেক প্রশ্ন রয়েছে। আমরা কিন্তু তাদের সহযোগিতা করছি। কারণ যতটুকুই সংস্কার হোক না কেন সেটা দেশের জন্য ভালো হবে বলে মনে করি। যেমন একটা বড় প্রশ্ন হচ্ছে, গণ অভ্যুত্থানটা কিন্তু কোনো রাজনৈতিক দলের নেতৃত্বে হয়নি। এখানে প্রধান স্টেকহোল্ডার হচ্ছে ছাত্র এবং জনগণ। আমরা যেটাকে বলছি ছাত্র-জনতা। ছাত্রদের যদি জনগণের অংশ ধরে নিই তাহলে জনগণ হচ্ছে গণ অভ্যুত্থানের প্রধান এজেন্ট। এখানে ঐকমত্যের কথা বলা হচ্ছে। সেটা হলো রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ঐকমত্য। এর পেছনে একটা অনুমান কাজ করছে কমিশন এবং সরকারের। সেটা হলো রাজনৈতিক দলগুলো যেহেতু জনগণের প্রতিনিধিত্ব করে সুতরাং রাজনৈতিক দলগুলো একমত হলেই জনগণ একমত হবে। এ ধারণাটি কিন্তু ঠিক না। রাজনৈতিক দলের বাইরে বিশালসংখ্যক জনগণ রয়েছে। জনগণের আলাদা একটা ক্যাটাগরি আছে। তা যদি না থাকত তাহলে গণ অভ্যুত্থান ঘটে না। সেটা হলে বিএনপির আন্দোলনের মধ্য দিয়েই সরকারের পতন ঘটত। ওই জিনিসটা ফেল করার পরে কিন্তু জনগণ হাজির হয়েছে। এ ঐতিহাসিক সত্যটা বোঝার মতো কনসেপচুয়াল ক্লারিটি এবং সদিচ্ছা দুটোরই অভার রয়েছে আমাদের সমাজের, সরকারের এবং কমিশনেরও। তিনি বলেন, জনগণের সিংহভাগ অংশ যেসব সংস্কার বিষয়ে একমত হবে, সব রাজনৈতিক দল যদি বিরোধিতা করে তার পরও কিন্তু আপনাকে ওই সংস্কারটা করতে হবে। এটাই নিয়ম। কিন্তু সেদিকে সরকার যাচ্ছে না।
সরকার ঘোষিত সময়ের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে এনসিপির দলীয় প্রস্তুতি কী হবে-প্রশ্নে তিনি বলেন, সাংগঠনিক কমিটি ও নিবন্ধন নেওয়া এ দুটো কাজ একসঙ্গে এগিয়ে নিচ্ছি। এসবের মধ্য দিয়ে একই সঙ্গে নির্বাচনেরও প্রস্তুতি নিচ্ছি। নির্বাচন প্রশ্নে প্রাথমিকভাবে আমরা আলাদা একটা বলয় হতে চাই, একটা সেন্টার হতে চাই। নিজেরা ৩০০ আসনে প্রার্থী দেওয়ার চিন্তা করছি। আমাদের যারা সম্ভাব্য প্রার্থী তারা ইতোমধ্যে এলাকায় কিছুটা গ্রহণযোগ্যতা তৈরি করেছেন। পাশাপাশি সমাজে যারা গ্রহণযোগ্য ব্যক্তি, মধ্যবয়স্ক, কিংবা আমাদের চেয়ে একটু সিনিয়র এ ধরনের মানুষকে পিক করার চেষ্টা করছি। নির্বাচনে জোট করার বিষয়ে এখনো কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি। তবে জোট যদি করতেই হয় তাহলে আমাদের নেতৃত্বেই জোট হবে। আমরা অন্য কারও জোটে যুক্ত হব সেটা হয়তো হবে না। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এলাকায় যখন আমাদের নেতারা যাচ্ছেন তখন তারা পুরোনো রাজনৈতিক বন্দোবস্তের মুখোমুখি হচ্ছেন। শোডাউন বলেন, টাকার ছড়াছড়ি বলেন, মাসল পাওয়ার বলেন। এসবের সঙ্গে তাদের ফাইট করতে হচ্ছে। সবাই সবকিছু করবে আর আমরা নতুন বন্দোবস্তের নামে কিছুই করতে পারব না, এটা ঠিক না। এ ক্ষেত্রে পুরোনো বন্দোবস্তের সঙ্গে আমাদের ফাইট দিতে হচ্ছে। পাশাপাশি নতুন বন্দোবস্তকে স্টাবলিশ করতে হচ্ছে।
নতুন বন্দোবস্তের ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে তিনি বলেন, মাসল পাওয়ারের রাজনীতি করব না, চাঁদাবাজির রাজনীতি করব না, মনোনয়ন বাণিজ্য করব না, অন্তঃকোন্দলে ৭০-৮০ জন নিহত হয় এ ধরনের রাজনীতি করব না। এর মানে এই নয় যে, আমরা একেবারে গান্ধীবাদী হয়ে বসে থাকব। তাহলে তো রাজনীতিই হবে না। আমরা অবশ্যই শোডাউন করব। আমার যদি এলাকায় ৫ হাজার মানুষকে নিয়ে হাঁটার সক্ষমতা থাকে তাহলে কেন হাঁটব না। এটা নিয়ে আমি জনগণের পাশে দাঁড়াচ্ছি নাকি তাদের মনে ভয় ধরাচ্ছি এটা গুরুত্বপূর্ণ। আমরা পুরোনো রাজনীতির কিছুটা খোলস নিচ্ছি কিন্তু তার মধ্যে নতুন কনটেন্ট যোগ করছি।
নতুন দল হিসেবে সাইবার জগতে নানা ধরনের আক্রমণ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আমাদের যারা থ্রেট মনে করছে তাদের অনেকেই সংঘবদ্ধভাবে সাইবার জগতে আক্রমণ চালাচ্ছে। বিশেষ করে আমাদের যেসব নারী নেত্রী আছেন তাদের বিরুদ্ধে ভয়ংকর বুলিং করা হচ্ছে। অনেককে থ্রেট দেওয়া হচ্ছে। প্রাণনাশের আশঙ্কা যেসব বুলিংয়ের মধ্যে আছে সেগুলোর বিষয়ে সরকারের খুব শক্ত অবস্থান নেওয়া উচিত। সমাজমাধ্যমে আমাদের ইতিবাচক ইমেজ ধারণ করতে হবে। সেটা নিয়ে কাজ করছি। তবে পেইড আক্রমণ হয়তো আমরা ঠেকাতে পারব না।
নিজেদের পরিকল্পনা প্রসঙ্গে সারোয়ার তুষার বলেন, ভবিষ্যতে এনসিপি বাংলাদেশের প্রধান রাজনৈতিক দল হবে। কারণ আমাদের নেতৃত্বেই শেখ হাসিনা সরকারের পতন হয়েছে। প্রত্যেকটা সময়ের একটা ফসল থাকে। এনসিপি হচ্ছে এই সময়ের ফসল। বর্তমানে বড় দলগুলোর সঙ্গে আমাদের দলের নাম জোরেশোরে উচ্চারিত হচ্ছে। এটা খুবই স্বাভাবিক।
নির্বাচন নিয়ে মাইনাস ফর্মুলা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এগুলো হচ্ছে অমূলক চিন্তা। বিএনপির তরফ থেকেই মাইনাস ফর্মুলার বিষয়টা বারবার বলা হচ্ছে। সময়টাকে ঠিকমতো ধরতে না পারার কারণে এ ধরনের অভিযোগ আসে। যখনই আপনি মাইনাসের কথা বলেন তখন আওয়ামী লীগকে ভিকটিমের মর্যাদা দেন। আমরা মনে করি বাংলাদেশে রাজনীতি মাইনাস ছিল গত ১৫ বছর। আওয়ামী লীগের অ্যাজেন্ডা ছিল ওয়ান ইলেভেনের এক্সটেনশন। তিনি বলেন, এ অভ্যুত্থানের পরে রাজনীতিটা প্রবলভাবে কামব্যাক করেছে। এটা একেবারে নজিরবিহীন। সব দল এখন ব্যাপকভাবে সক্রিয় হয়ে উঠেছে। পুরোনো রাজনৈতিক বন্দোবস্তের কারণে বিএনপির মধ্যে কোন্দল হচ্ছে। কিন্তু এক দলের সঙ্গে অন্য দলের এটা হচ্ছে না। তাই এখন যে কোনো ধরনের মাইনাসের আলোচনাটা একেবারে অপ্রাসঙ্গিক।
গণ অভ্যুত্থান নাকি বিপ্লব-এনসিপির কাছে এ প্রশ্নের উত্তর কী? এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, গণ অভ্যুত্থান আর বিপ্লব মুখোমুখি কোনো বিষয় না। আমরা যখন বলতে চাই এটা বিপ্লব না তখন রুশ বিপ্লব বা চীন বিপ্লবের বিষয়টা মাথায় রেখে বলছি। আমরা কিন্তু ফ্যাসিবাদ থেকে গণতন্ত্রের দিকে যাচ্ছি। পৃথিবীর যেসব রাষ্ট্রকে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে মানি তারা প্রত্যেকেই কিন্তু বিপ্লবের ফসল। আমরা একটা গণতান্ত্রিক বিপ্লবের পর্যায়ে আছি। বিপ্লবটা শুরু হয়ে গেছে। এর মধ্যে অনেক চড়াই-উতরাই আছে। উত্থানপতন আছে। অ্যাবসলিউটলি গণতান্ত্রিক বিপ্লবের যে রোডম্যাপ সে রোডম্যাপেই আছি। এর সঙ্গে অভ্যুত্থানের কোনো বিরোধিতা নেই। কোনো কোনো জায়গায় বিপ্লব সশস্ত্র কায়দায় হয়, কোনো জায়গায় ভ্যানগার্ড পার্টির আন্ডারে হয়। এখানে গণ অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে হয়েছে। তাই এখানে আলাদা করে কিছু দেখি না।