বাংলাদেশি নাটকের সুনাম এখন মধুর অতীত। বর্তমানে মানহীন নাটকের ছড়াছড়ি। কোনো রকম যত্ন ছাড়াই যেনতেনভাবে নির্মাণের কারণেই নিম্নমানের নাটক নির্মাণ হচ্ছে। তাই নাটক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন দর্শক।
বিটিভির ওপর থেকে দর্শক আশা হারিয়েছেন অনেক আগেই। ভরসা ছিল শুধু স্যাটেলাইট টিভি চ্যানেলগুলোর ওপর। কিন্তু এখন সে চ্যানেলগুলোতেও নাটক নামে চলছে মানহীন নাটক। পাশাপাশি রয়েছে বিজ্ঞাপন অত্যাচার। তাই দেশি চ্যানেল থেকে মুখ ফিরিয়ে রিমোট টিপে দর্শক চলে যাচ্ছে বিদেশি চ্যানেলে। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বর্তমানে একক নাটক নির্মাণ হচ্ছে মাত্র দুই দিনে। তাই যত্ন নিয়ে নাটক নির্মাণ করতে পারছেন না নির্মাতারা। ফলে নিম্নমানের নাটকে ভরে যাচ্ছে টিভি পর্দা। বাজেট কমে যাওয়ার কারণেই দুই দিনে নাটকের শুটিং শেষ করতে হচ্ছে। নির্মাতারা জানিয়েছেন, ভালোভাবে একটি একক নাটক নির্মাণ করতে খরচ হয় তিন থেকে সাড়ে তিন লাখ টাকা। কিন্তু বাজেট এসে দাঁড়িয়েছে এক লাখ আশি হাজার থেকে সর্বোচ্চ দুই লাখে। এর মধ্যে আবার অভিনয়শিল্পীরা আকাশচুম্বী পারিশ্রমিক বাড়িয়েছে। সব মিলিয়ে হিমশিম খেয়ে দুই দিনেই নাটক নির্মাণ করতে হচ্ছে। তাই মান রক্ষা করা যাচ্ছে না। কোনো নির্মাতা মান ধরে রাখার জন্য তিন কিংবা চার দিন শুটিং প্ল্যান করতে পারছেন না। যদি কেউ করেন তাহলে তাকে পকেট থেকে টাকা খরচ করতে হচ্ছে।
নাটক নির্মাণে বর্তমানে কোনো শৃঙ্খলাই নেই। ভেঙে পড়েছে বাজেট সিস্টেম। সবমিলিয়ে নাটকের মান রক্ষা করা কোনোভাবেই সম্ভব হচ্ছে না। ফলে দর্শক আর চোখ রাখছেই না পর্দায়। সবাই মনোযোগী ভারতীয় সিরিয়ালের ওপর। শুধু দর্শকই নয়, দেশীয় বিজ্ঞাপন বাজারও এখন রপ্তানি হয়ে যাচ্ছে ভারতীয় টিভি চ্যানেলে। অর্থনৈতিক দৈন্য আর সঠিক পরিকল্পনার অভাবে যাচ্ছেতাই অবস্থা দেশের দুই ডজন টিভি চ্যানেলের। তাই তো মানহীন নাটকের সংখ্যা বেড়ে চলছে দিনকে দিন। বর্তমান পরিস্থিতি সম্পর্কে নির্মাতা মোস্তফা সরয়ার ফারুকী বলেন, 'আমাদের টেলিভিশন ইন্ডাস্ট্রি প্রয়োজনের তুলনায় বেশি ফুলে-ফেঁপে গেছে। তাই আমরা দর্শক হারাচ্ছি। যেখানে দেশে চ্যানেল থাকা উচিত ছিল মাত্র সাত-আটটি সেখানে এখন ২৫টির ওপর। আরও আসছে। এসব হচ্ছে রাজনৈতিক অভিলাষের কারণে।' বাংলাভিশনের অনুষ্ঠান প্রধান শামীম শাহেদ বলেন, 'নাটকের ফাঁকে বিজ্ঞাপনের চাপটা বেশি হয়ে যাচ্ছে। আমরা ভালো করব, যদি দর্শকদের মাসিক ক্যাবল ভাড়ার কিছু অংশও চ্যানেলের কোষাগারে জমা পড়ে। আর কিছু লাগবে না। তখন আর আমরা ১০ মিনিটের নাটকের জন্য ২৫ মিনিটের বিজ্ঞাপন খুঁজব না। পৃথিবীর সব দেশেই টিভি চ্যানেলগুলো ক্যাবল লাইন থেকে টাকা পায়, আমরাই শুধু বিনা পয়সায় দিয়ে যাচ্ছি। বিষয়টা এমন হয়েছে এখন, পয়সা দিয়ে কেনা বিদেশি চ্যানেলের সঙ্গে দেশীয় চ্যানেলগুলো ফ্রি! এই ফ্রি কালচার বন্ধ না হলে এর সমাধানও আসবে না। দর্শক পাচারও বন্ধ হবে না'। এদিকে একই প্রসঙ্গে শতভাগ সফল অভিনেতা-নির্মাতা মাহফুজ আহমেদ বললেন খানিক ভিন্ন কথা। তিনি বলেন, 'সমস্যাটা খুব গভীরে। তবে আমি সমস্যা না, আশার কথা বলতে চাই। চ্যানেলে একটা বা দুটো স্পেশাল নাটক বা অনুষ্ঠান থাকা দরকার, যেখানে বিজ্ঞাপন কম যাবে। কিন্তু একটি চ্যানেলেও স্পেশাল কোনো কিছু নেই। নিজেদের টিকিয়ে রাখার জন্য স্পেশাল এবং এঙ্ক্লুসিভ কিছু রাখা উচিত, এগুলোই অন্য চ্যানেল থেকে নিজেদের আলাদা করবে এবং টিকিয়ে রাখবে'। রাজনৈতিক বিবেচনায় বছর বছর অযথাই চ্যানেল বাড়ছে, সেই সুবাদে গড়ে উঠছে মেধাহীন টেলিভিশন প্রজন্ম। এ ছাড়া গল্প-অভিনয়শিল্পী-বাজেটের অভাবেও মানহীন নাটকের সংখ্যা বাড়ছে। আর এসব সমস্যা সমাধানে টিভি চ্যানেলগুলো দ্রুত কার্যকর পদক্ষেপ না নিলে 'ভালো নাটক' শব্দটা জাদুঘরে চলে যাবে।