শিল্প-মানসম্পন্ন নাটক ও চলচ্চিত্র নির্মাণের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ উপকরণ হচ্ছে পাণ্ডুলিপি। কিন্তু মঞ্চে পাণ্ডুলিপির সংকট প্রকট আকার ধারণ করেছে। তাই মঞ্চনাটক বর্তমানে বিদেশি নাট্যকারদের ওপর নির্ভরশীল। দেশের প্রায় সব শীর্ষস্থানীয় নাটকের দলই তাদের প্রযোজনাগুলোতে টেনে আনছেন উইলিয়াম শেকসপিয়র, মলিয়ের, ইবসেনসহ খ্যাতিমান বিদেশি নাট্যকারদের। আর মাঝারি গোছের দলগুলো পাণ্ডুলিপির অভাবে নিয়মিত প্রযোজনার কাজটি অব্যাহত রাখতে পারছেন না। সব মিলিয়ে দেশের মঞ্চগুলোতে এখন আর মৌলিক নাটকের মঞ্চায়ন হচ্ছে না বললেই চলে। এ বিষয় নিয়ে মঞ্চের বিশিষ্টজনদের মন্তব্য তুলে ধরেছেন মোস্তফা মতিহার-
আতাউর রহমান
স্বাধীনতা-পূর্ববর্তী সময়ে আমাদের নাট্যাঙ্গনে দেশি নাট্যকারের বিশাল ভূমিকা ছিল। '৬৮ সালে নাগরিক নাট্য সম্প্রদায় প্রতিষ্ঠার পর দেশীয় নাট্যকারদের নাটকগুলোই আমরা বেশি করেছি। নুরুল মোমেন, আসকার ইবনে শাইখ, মুনীর চৌধুরীর মতো নাট্যকাররা তাদের সৃজনশীলতাকে দিয়ে আমাদের এ অঙ্গনকে সমৃদ্ধ করেছিলেন। স্বাধীনতা-পরবর্তী ১৯৭২ সালে মহিলা সমিতির মঞ্চে দর্শনীর বিনিময়ে প্রথম মঞ্চনাটক শুরু হয়। আর নাগরিক নাট্য সম্প্রদায় সেই গর্বিত ইতিহাসের ধারক-বাহক। পরবর্তী সময়ে আমাদের মমতাজউদ্দীন আহমদ, মামুনুর রশীদ, সৈয়দ শামসুল হকরা ভালো লিখেছেন। তাদের নাটকগুলোও সমাদৃত। এরপর মানসম্পন্ন পাণ্ডুলিপি না পাওয়ায় বিদেশি নাট্যকারদের প্রতি আমরা নির্ভর হয়ে পড়ি। বিদেশি নাট্যকারের নাটক করা তো দোষের কিছু না। এতে প্রাচ্যের সঙ্গে পাশ্চাত্যের একটা সুন্দর সেতুবন্ধন হয়ে থাকে। সংস্কৃতির ক্ষেত্রে যেটা ভালো সেটা অবশ্যই গ্রহণ করা উচিত। বিদেশিদের বৈচিত্র্যপূর্ণ নাটক দিয়ে আমরা নিজেরাও সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে যাচ্ছি। পাশাপাশি দেশি নাট্যকারও তৈরি করতে হবে।
ড. ইনামুল হক
আমাদের এখানে ভালো নাট্যকারের অভাব রয়েছে এটা আমি খুব একটা মানতে পারি না। নানা প্রতিকূলতার মধ্যেও আমাদের নাট্যাঙ্গনেও অনেক মানসম্পন্ন নাট্যকার রয়েছে। তাদের সেভাবে মূল্যায়ন করা হচ্ছে না। মানসম্পন্ন অচেনা নাট্যকারদের তুলে ধরতে সাংবাদিকদের একটা বিশাল ভূমিকা রয়েছে। নাটকের মানুষদের পাশাপাশি সাংবাদিকদেরও এ বিষয়ে এগিয়ে আসতে হবে। মানসম্পন্ন নাট্যকারদের যদি মূল্যায়ন করা হয় তাহলে তারা ভালো কাজের অনুপ্রেরণা পাবে। দেশি নাট্যকার থাকলে বিদেশি নাটকের সংখ্যা কমবে। আর বিদেশি নাটককে আমরা সরাসরি অনুবাদ করছি না, রূপান্তর করছি। যেমন আমাদের দলের নাটক 'পুসি বিড়াল ও একজন প্রকৃত মানুষ' বিদেশি নাটক হলেও সেটাকে আমরা শুধু অনুবাদই করিনি, রূপান্তরও করেছি। বিদেশি গল্পের ছায়া অবলম্বনে নাটকে দেশি বিষয়কে তুলে ধরার চেষ্টা করেছি। বিড়াল চরিত্রটিকে রূপক অর্থে ব্যবহার করেও নাটকটিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ ম্যাসেজ দেওয়ার চেষ্টা করেছি।
রামেন্দু মজুমদার
একটি নাটকের দলের নতুন নতুন নাটকের জন্য যে ধরনের পাণ্ডুলিপি দরকার সে ধরনের পাণ্ডুলিপি খুব একটা পাওয়া যায় না। সফল দলের মঞ্চায়নের ধারাবাহিকতা রক্ষার ক্ষেত্রে ভালো মানের নাট্যকার আমাদের এখানে খুবই কম। শুধু পাণ্ডুলিপি সংকটের কারণেই অনেকগুলো নাটকের দল নিয়মিতভাবে নতুন নতুন প্রযোজনা মঞ্চে আনতে পারছে না। যার কারণে দল টিকিয়ে রাখতেই বিদেশি নাট্যকারদের নাটকের অনুবাদ বা রূপান্তরের মাধ্যমে আমাদের নাটকের দলগুলো তাদের প্রযোজনাগুলো অব্যাহত রাখে। বিদেশি নাট্যকারদের নাটক মঞ্চায়নের ক্ষেত্রে একটা বিষয় অবশ্যই খেয়াল রাখা উচিত। আর তা হলো তাদের যে নাটকটির সঙ্গে আমাদের সংস্কৃতির সামঞ্জস্য নেই সেই নাটকটিকে এড়িয়ে যাওয়া উচিত। আর যার সঙ্গে আমাদের সংস্কৃতির সামঞ্জস্য আছে সেই নাটকটিই মঞ্চায়ন করা উচিত। আমাদের নাট্যকারের সংখ্যা বৃদ্ধি পেলে বিদেশি নাট্যকারদের ওপর আমাদের নির্ভর করতে হতো না। আমাদের দেশের নামি সাহিত্যিক ও ভালো মানের লেখকরা যদি পাণ্ডুলিপি রচনায় এগিয়ে আসে তাহলে এই সংকট দূর হবে। এ ছাড়া নাটকের দলগুলো মধ্যে যাদের ভালো লেখার হাত রয়েছে তাদেরও কাজে লাগাতে হবে।
কেরামত মওলা
শিল্প-বোধসম্পন্ন নাট্যকাররা লিখছেন না। সৈয়দ শামসুল হক খুব কম লিখছেন। সেলিম আল দীনের মতো নাট্যকাররা আমাদের মাঝে নেই। মঞ্চনাটক লিখতে হলে যে ধরনের অভিজ্ঞান ও অভিজ্ঞতা দরকার সে ধরনের অভিজ্ঞান এখনকার অনেক লেখকের নেই। শিল্পবোধ না থাকলে মঞ্চনাটক লেখা যায় না। মঞ্চনাটকে কোনো ধরনের প্রাপ্তি নেই বলে অনেকেই এখন আর মঞ্চের জন্য নাটক লিখছেন না। টেলিভিশনে প্রাপ্তি আছে বলে নাট্যকাররা এখন টিভি নাটক লিখায় ব্যস্ত। তবে এটাও ঠিক, টিভি নাটক ও মঞ্চনাটক রচনার ক্ষেত্রে কিছুটা পার্থক্য রয়েছে। শিল্পবোধ না বুঝলেও যে কেউ টিভি নাটক লিখতে পারে কিন্তু মঞ্চনাটক একটু কষ্টসাধ্য। মঞ্চনাটক লেখাটাও অনেক কঠিন কাজ। যারা ভালো লিখে থাকেন তাদের অনুরোধ করব যেন তারা মঞ্চকে অবহেলা না করে নাটক লেখায় এগিয়ে আসে।